প্রতি বৎসরের ন্যায় এবারও ঘটা করে পার হয়ে গেল ২০২৫ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী, যা বাঙ্গালী জাতির টানিং পয়েন্টের একটি মাইলফলক। ১৯৫৩ নং সন থেকেই দলমত ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে বির্তকহীন ভাবে দিনটি মাতৃভাষা দিবস হিসাবে প্রতিবৎসর যথাযথ মর্যাদার সাথে পালিত হয় যার কলেবরও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে শহীদ মিনার নির্মানে পাকিস্তান সরকার বাধা দিয়েছিল, ভেঙ্গে ফেলেছিল নির্মানাধীন মিনার, সেই মিনারই এখন নির্মিত হয়েছে জেলা, মহানগর, শহর, বন্দর ও গ্রামে-গঞ্জে। কর্তৃপক্ষের কোন প্রকার সহযোগীতা না পেলেও নিজেদের অর্থায়নেই কোমলমতি ছাত্র/ছাত্রীরা নিজ দ্বায়িত্বে কায়িক পরিশ্রমে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিত্তি স্থাপনের সূচনা করে ছিল শহীদ মিনারের। ১৯৫৩ ইং সাল থেকে বাঙ্গালী জাতি শ্রদ্ধার সাথে প্রতি বৎসর পালন করা দিবস উৎযাপন এখন শুরু হয় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতির শহীদ বেদীতে পুষ্প প্রদানের মাধ্যমে। প্রভাত ফেরীতে ছাত্র/ছাত্রীদের পাশাপাশি শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল স্তরের সকল পেশার মানুষের অংশগ্রহন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদানের জন্য “একুশে পদক” প্রবর্তন হয়েছে; যদিও পদক প্রদানে অগ্রাধিকার পাচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনা, অবদানের ভিত্তিতে নহে। বাংলা একাডেমীর উদ্দেগ্যে পুরো ফেব্রুয়ারী মাস জুড়েই পালিত হয়ে আসছে অমর একুশে বই মেলা, যার উদ্বোধন পরম্পরা ভাবে করে আসছেন সরকার প্রধান। বই মেলা উপলক্ষে লেখক পাঠকদের মিলন মেলায় পরিনত হয় বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গন সহ সরোওয়াদী উদ্দ্যান। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ব বিদ্যালয় পর্যন্ত আলোচনা সভা, কবিতা আবৃত্তি ম্যাগাজিন/সরনীকা প্রকাশ প্রভৃতি ব্যাপক ভাবে পালিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারীকে ঘিরে সর্বত্র।
“একুশ মানে মাথা নত না করা” শ্লোকটিকে জাতি প্রতিপদ্য হিসাবে গ্রহন করেছে। তদুপরি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা “আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলতে পারি?” গানটি দেশে বিদেশে বাঙ্গালী মাত্রই প্রানে স্পন্দন জোগায়। কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে একটি জাতি লালিত পালিত হয় যা সমৃদ্ধশালী হয় এর চর্চার মাধ্যমে। যুদ্ধ বা আন্দোলন-সংগ্রাম বা অভ্যুথান বা বিপ্লবের মাধ্যমে কোন এক বা একাধিক ভূ-খন্ড নিয়ে একটি রাষ্ট্রের জন্ম বা নাম পরিবর্তন এবং পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা লাভ করতে পারে, কিন্তু শত বৎসর বা যুগ যুগান্তর চর্চার পর প্রতিষ্ঠিত হয় একটি জাতির কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। ধর্মের প্রবক্তা আছে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হয় এবং যে কোন প্রতিষ্ঠানের উদ্দোক্তাকেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে স্বীকৃত দেয়া হয়। কিন্তু কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উৎপত্তি হয় কোন জনগোষ্ঠির অভ্যাসগত অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে যার কোন প্রতিষ্ঠাতা বা উদ্দ্যোক্তা বা ভূ-খন্ড ভিত্তিক সীমারেখা থাকে না। ইতিহাসবিদদের মতে বঙ্গোপসাগরে গজে উঠা একটি দ্বীপ থেকে বাংলাদেশের সৃষ্টি। এ দেশ বহুবার বিভিন্ন পন্থায় ভিনদেশীদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। পাল রাজ থেকে পলাশী এবং বৃটিশ রাজ থেকে বঙ্গভবন ১৯৭১ইং সাল পর্যন্ত ভিন ভাষা-ভাষী ভিন-দেশীরা এ ভূখন্ডকে শুধু শাসন শোষন করে নাই, বরং তাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি দিয়ে বাঙ্গালীদের ভিনদেশীদের রঙ্গে রঞ্জিত করার চেষ্টা করেছে; যদিও কোথাও কোথাও আংশিক সফল হয়েছে; যেমন কোলকাতারা উচ্চ বর্ণের বাবুরা ইংরেজী সংস্কৃতিকে অনুশীলন অনুকরন করলেও জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ভিনদেশী শাসকদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে বাঙ্গালীদের ভিতরে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু বাঙ্গালীরা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তাদের নিজ সংস্কৃতি থেকে সরে আসে নাই। তার অন্যতম প্রমান বাঙ্গালীর ভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে জীবন উৎসর্গ করেছে। ভিন্নদেশী শাসকরা তাদের ভাষা ইংরেজী, ফার্সী, উর্দুকে বিভিন্ন পন্থায় রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল; ৭৮ বৎসর পূর্বে বৃটিশ অখন্ড ভারত থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালত, উচ্চ শিক্ষা প্রভৃতি সবকিছুতেই ইংরেজী ভাষাকে সর্বোকৃষ্ট অগ্রাধিকার দিয়ে এখন শক্ত ভাবে ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পাকিস্তান সরকারের পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর (যাদের নাম সরকারী ভাবে পাওয়া যায়) জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু দেশী/বিদেশী লেখদের মতে শহীদের সংখ্যা আরো বেশী। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এর কোন পরিসংক্ষন নাই। শহীদের সংখ্যা সহ অন্য যে কোন বিষয়েই বির্তক বা আলোচনা থাকুক না কেন ঘটনাটি ঘটে ছিল বাংলা দিন পঞ্জিকা মতে “৮ই ফাল্গুন”; অথচ প্রতিষ্ঠা পেল ইংরেজী দিন পঞ্জী মোতাবেক “২১ শে ফেব্রুয়ারী” যা পশ্চিমাদের সংস্কৃতি ও ব্যবহার্য দিন পঞ্জি বটে। প্রশ্ন হলো বাঙ্গালীরা জীবন দিলো বাংলার জন্য অথচ গুরুত্ব পেলো ইংরেজী ক্যালেন্ডারে যা মূলত বাঙ্গালীর আদি সংস্কৃতির ধারাক নহে, বরং ভিন দেশীয় সংস্কৃতি যা অনুপ্রবেশ করেছে দখল দারিত্বের মাধ্যমে; যার ইতিহাস অনেক নির্মম ও ছলনা মূলক।
১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত প্রায় একশ বছর মুসলমানরা সম্পূর্ণভাবে ইংরেজ বশ্যতা স্বীকর করেনি। অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরোক্ষভাবে বশ্যতা স্বীকার করেন এই যুক্তিতে যে মোগল সম্রাজ্যের পরিবর্তন এবং বৃটিশদের আগমন তাদের জন্য কোন ক্ষতির কারন হবে। ইংরেজরা অনেক ধাপে ধাপে অনেক সুকৌশলে অখন্ড ভারত দখলে নেয়। তাদের কৌশল ছিল Slow Poison এর মত; তাদের প্রথম ধাপ ছিল সওদাগরী, দ্বিতীয়ত: মিশনারী, তৃতীয়ত: রণতরী, চতুর্থত: ষড়যন্ত্র ছিল বৃটিশ শাসন স্থাপনে কূটনৈতিক বৃদ্ধিমত্তা।
মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিনত করার আন্দোলন বিরন ঘটনা। মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনেক দেশেই আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয় নাই। কারন মাতৃভাষার প্রয়োগ ও মর্যাদা রক্ষা একটি মৌলিক ও জন্মগত অধিকার। পাকিস্তান সরকার বাঙ্গালীদের সে অধিকার ক্ষুন্ন করেছে বিধায় ১৯৭১ ইং সনে এ দেশে থেকে তারা বিতারিত হয়। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আসাম রাজ্যে অনুরুপ একটি আন্দোলন হয়ে ছিল। ১০ অক্টোবর, ১৯৬০ আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা আসামীয়কে (আসামের আদিবাসীদের ভাষা) সরকারী ভাষা করার জন্য প্রস্তাব দেয়ার প্রতিবাদে শিলচর রেলষ্টেশনে সত্যাগ্রহীদের উপর আসামী প্যারামিলিটারী বাহিনী সাত
মিলিট ১৭ রাউন্ড গুলি ছোড়ে তাতে ১১ জনের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য নামে দশম শ্রেনীর এক ছাত্রী ছিল। অন্তে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে সহযোগী সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃত প্রদান করা হয়। গুলিবর্ষনের এলাকাভূক্ত রেলষ্টেশনকে জনগণ “ভাষাসৈনিক শিলচর রেলষ্টেশন” নাম করন করেছেন যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
আমি ইংরেজী ভাষা শিক্ষা বা এই ভাষায় পারদর্শী হওয়ার বিপক্ষে নহে, বরং পক্ষ পাতি; এজন্য যে, ইংরেজী ভাষা আর্ন্তজাতিক বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দখলদার ইংরেজদের সংস্কৃতি আমি নিজের মধ্যে ধারন করার বিরোধী, যেমন বাংলা দিনপঞ্জি ৮ই ফাল্গুনের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ২১শে ফেব্রুয়ারী। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ২১শে ফেব্রুয়ারী উৎযাপিত হউক কিন্তু অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৮ইং ফাল্গুনকে ভাষা শহীদ দিবস হিসাবে সম্মানিত করে যথাযথ মর্যাদায় জাতীয় মাতৃভাষা দিবস উৎযাপন করলে বাঙ্গালী মাত্রই প্রতিটি মানুষ আত্মতৃপ্তি লাভ করবে। আমি মনে করি বাঙ্গালীয়ত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একুশে বই মেলার নাম “ফাল্গুনী বই মেলা” নামে নামকরন করাই যুক্তি সংগত। এছাড়াও বিশেষ ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে অবদানের জন্য একুশে পদক এর পরিবর্তে “ফাল্গুনী পদক” নাম করন করা হউক। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সঠিক সংখ্যা নিরুপনের জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করার জন্য আমি জোর দাবী জানাচ্ছি। আমার প্রস্তাবাটি কতৃপক্ষের বিবেচনায় আসলে বাঙ্গালী কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে মূল্যায়ন করা হবে।
২১ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ৬ই মার্চ, ২০২৫ইং
লেখক: তৈমূর আলম খন্দকার
জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমী, সাবেক সিনেটর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়