ডেস্ক রিপোর্ট, সান নারায়ণগঞ্জ
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই আন্দোলনে গণহত্যার বিচার পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলেছে। সেখানে কোনো গাফিলতি থাকবে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের সরকারের শাসনামলেই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে।
শহীদ পরিবারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের মনে সব সময় একটা আর্তি থাকে, একটা ক্রন্দন থাকে—এত বড় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হলো, এমনভাবে আমাদের লোকদেরকে হত্যা করা হলো, আমাদের ভাইদের চোখ কেড়ে নেওয়া হলো, অঙ্গহানি করা হলো…জঘন্য, বীভৎস, নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার কোথায়?” আমি আপনাদেরকে দৃঢ় কণ্ঠে জানাতে চাই, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবেই।
১৪ জুলাই সোমবার বিকেল ৪টায় নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ এলাকায় জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, জুলাই মাস আসলে আমাদের গত বছরের জুলাইয়ের কথা মনে পড়ে। জুলাই মাসের সূচিত আন্দোলনে গত সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশে যে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, বাংলাদেশের মানুষ ৩৬ দিনে নয়, বড়জোর ১৫ দিনে এই শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করেছে, বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করেছে।
আইজিপি ছাড়াও বিভিন্ন যে অপরাধ আদালতে বা ক্রিমিনাল কোর্টে রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন মামলা করা হয়েছে। আমি এখানে (নারায়ণগঞ্জে) মামলাগুলোর খোঁজ নিয়েছি। আমাকে এসপি সাহেব বলেছেন, অনেকগুলো মামলার তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। ওনাদের আমি অনুরোধ করেছি যে, আপনারা চেষ্টা করেন ৫ আগস্টের আগে মামলাগুলোর চার্জশিট দেওয়ার জন্য। উনি আমাকে নিশ্চিত করেছেন, অনেকগুলো মামলার চার্জশিট দিতে পারবেন। চার্জশিট দেওয়ার পর বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হবে। বিচারকে ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজন হলে আমরা দ্রুত বিচার আইনে এ সমস্ত অপরাধের বিচার করব।
তিনি বলেন, আমাদের আত্মত্যাগ, আমাদের বেদনা, আমাদের ক্ষোভ, আমাদের সাহস সবকিছুর মধ্য দিয়ে আমরা একটা পরিবারে পরিণত হয়েছিলাম। এই ফ্যাসিবাদীদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ একটা পরিবারে পরিণত হয়েছিল। আমরা বৈষম্যহীন, শোষণহীন নতুন একটা বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র থাকবে, যেখানে কোনো শাসক এসে অপশাসকে পরিণত হবে না, যেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র থাকবে।
সাম্প্রতিক বিষয়ে তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে নানান আইনশৃঙ্খলা লঙ্ঘন ও বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটছে। ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটছে। চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। জুলাইয়ের সময় আপনারা যে ঐক্যবদ্ধভাবে মহাপরাক্রমশালী ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাজিত করেছিলেন, অবশ্যই আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে চাঁদাবাজদের প্রতিরোধ করতে পারবেন। আমাদের সরকারের দায়িত্ব থাকবে, পাশাপাশি আপনারা স্থানীয়ভাবে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। প্রশাসন আপনাদের সহযোগিতা করবে।
এদিন আরও বক্তব্য দেন শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। তিনি বলেন, বিভিন্ন জেলায় ‘জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গণভবনকে একটা ফ্যাসিবাদবিরোধী জাদুঘর গড়ে তোলার জন্য কাজ চলছে। ৫ আগস্টের আগেই এটার উদ্বোধন করা হবে। এটা স্বৈরাচারের ঠিকানা। আমরা এই ঠিকানাকে সংরক্ষণ করতে চাই, দেখাতে চাই—এখানে ফ্যাসিবাদ কীভাবে মানুষকে অত্যাচার করত।
তিনি বলেন, আমরা উদ্যোগ নিয়েছি শহীদদের সমস্ত কবরগুলো সংরক্ষণ করার জন্য। আমরা কাজগুলো শেষ করতে চাই। তবে সংগ্রামের ধারা শেষ করতে পারব না, এটা আপনাদের কাছে দিয়ে যাব। আপনারা অগ্নিযুগের সন্তান, আগুন হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। আপনারা এগিয়ে নিয়ে যাবেন। বাংলাদেশে যেন কখনো কোনো আধিপত্যবাদী শক্তি চোখ রাঙাতে না পারে। ফ্যাসিবাদ না আসতে পারে। আসার চেষ্টাও করা হলে সেটাকে দমন করা হবে।
তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের সংগ্রাম চলেছিল। এই সংগ্রামে বহু মানুষ গুম হয়ে যায়। বিচারবহির্ভূত নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। অনেক আয়নাঘর তৈরি করা হয়েছিল। এই সংগ্রামের এক পর্যায়ে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ, ছাত্ররা বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে এবং অগ্নিকন্যারাও নেমে এসেছিলেন রাজপথে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমাদের শিক্ষার্থী, ছাত্র-জনতা দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছে, বৈষম্যমুক্ত করেছে। তাদের ত্যাগের মাধ্যমে আমরা স্বৈরাচারমুক্ত দেশ পেয়েছি। এই জুলাইকে স্মরণ করে আজ আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি। জুলাইকে আমাদের সবসময় স্মরণ করতে হবে। এই নারায়ণগঞ্জে ৫৬ জন শহীদ হয়েছেন। বুলেটের সামনে সেদিন তারা বুক পেতে দিয়েছিল। আর এই ৫৬ শহীদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সন্তান ছিল ২১ জন। তাদের স্মরণে এবং তাদের পরিবার যে এত বড় আত্মত্যাগ করেছে, তা স্মরণে আজ নারায়ণগঞ্জে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, শহীদরা এক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জীবন দিয়েছিল। আর ওই উদ্দেশ্য হলো বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তাদের শ্রদ্ধা করার একটি উপায় হচ্ছে দোষীদের বিচার কাজ নিশ্চিত করা। আর যেন বাংলাদেশের সরকার, বাংলাদেশের কোনো বাহিনী নিজ দেশের মানুষের ওপর গুলি চালাতে না পারে। আমরা এই বিচার প্রক্রিয়া সামনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা শুধু নিহত করার বিচারই নয়, মানুষকে অন্ধ করার, পঙ্গু করার বিচারও করব। মোটকথা, যারা যৌক্তিক আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ করেছে, সে বিচার আমরা সম্পন্ন করব।
তিনি আরও বলেন, আন্দোলনকারীদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল দেশকে বৈষম্যমুক্ত করা। আর এটি করার একমাত্র উপায় হচ্ছে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। শুধু একটি উপায়েই দেশকে গণতন্ত্রমুক্ত করা যাবে না। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। এর আগেও দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলন করতে হয়েছিল। জুলাইতে যদি ছাত্র-জনতা বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে না দিত, নির্ভীক না হতো, তাহলে ৫ই আগস্ট ঘটতো না। আর আমরাও এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারতাম না।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শহীদদের পরিবার, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা, জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদারসহ জেলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।