যেসব কারনে আইনের ফাঁদে শামীম ওসমানের লোকজন

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

নারায়ণগঞ্জে একের পর আইনের ফাঁদে বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের দেশব্যাপী আলোচিত সমালোচিত প্রভাবশালী আওয়ামীলীগের এমপি একেএম শামীম ওসমানের লোকজন। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন নেতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জে। বেশকজনের বিরুদ্ধে মামলা ও জিডি হওয়ার পর কিংবা অভিযোগ ওঠার পরপরই দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন তার অনুগামী নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ পুুলিশের হাতে এক কোটি টাকা চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন সিদ্ধিরগঞ্জ যুবলীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম। এসপি হারুন অর রশীদ বলেছেন, ‘আইন সবার জন্য সমান।’ তিনি সেটারই প্রতিফলন দেখাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জে।

ইতিমধ্যে বেশকজন শামীম ওসমানের খুবই ঘনিষ্ঠ কর্মী বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আবার তার আপন শ্যালকের বিরুদ্ধে মামলায় অভিযোগ তোলা হয়েছে তিনি মাদক বিক্রয়ে সহযোগীতাকারী। তার সবচেয়ে কাছের ডান হাত, বাম হাত বলতে নেতাকর্মীদের ভাষ্যে যা বুঝায় সেই শাহনিজামের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে করেছেন জিডি। তার একমাত্র ছেলে অয়ন ওসমানের শ্যালকের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে থানায়। শামীম ওসমানের এমন করুণ দশা যে, তার একজন ঘনিষ্টজন সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ডিস বাবু পুলিশ গ্রেপ্তারের পর পুলিশের এসপির কাছে গিয়েছিলেন তদবির নিয়ে। কিন্তু পুলিশ সুপার নাকচ করে দিলেন।

গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের সময় বর্তমান পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদের প্রতি বিএনপি নানা কারনেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের পর সেই পরিস্থিতি পুরোটাই পাল্টে দিলেন এসপি হারুন অর রশীদ। ইতিমধ্যে যেসব সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও চাঁদাবাজদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ তাদের বেশির ভাগই শামীম ওসমানের নাম ভাঙ্গিয়ে এসব অপকর্ম করে আসতো। বিভিন্ন সভা সমাবেশে শামীম ওসমানের চার পাশেও দেখা গিয়েছিল এদের বেশকজনকে। আবার তার মিটিং মিছিলেও তাদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতই। ফলে এসব অপকর্মকারীদের দাপটে টটস্ত ছিল নারায়ণগঞ্জের মানুষ।

সূত্রে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার আলোচিত সন্ত্রাসী শাহআলম গাজী ওরফে টেনু গাজীকে একটি মারধরের মামলায় গ্রেপ্তা করে পুলিশ। ২০ জানুয়ারি ফতুল্লা কুতুবপুরের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী সন্ত্রাসী মীর হোসেন মিরুকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা(ডিবি) পুলিশ। পৃথক দুটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মীরু কুতুবপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি শামীম ওসমানের বলয়ে রাজনীতি করেন। গত ৬ এপ্রিল এমপি শামীম ওসমান ফতুল্লায় এক জরুরী কর্মী সভায় মীরুকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, মীরুর দুটি পা নেই, একজন পঙ্গু লোককে গ্রেপ্তার করা হলো!

এছাড়াও গত ১৮ ফেব্রুয়ারি শহরের নিতাইগঞ্জ এলাকায় মসজিদের টাকা আত্মসাত নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের ১৮নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর কবির হোসাইন ও সাবেক কাউন্সিলর কামরুল হাসান মুন্না বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে সেখান থেকে ওই দুই নেতা সহ ২২ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের আদালতে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে পাঠায় পুুলিশ। যার মধ্যে কামরুল হাসান মুন্না মহানগর শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক। আদালতে তারা সমঝোতার শর্তে জামিন পান। ২০ এপ্রিল ফতুল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসী মোফাজ্জল হোসেন চুন্নুকে অস্ত্র সহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওইদিন তিনটি থানায় বিশেষ অভিযোন চালিয়ে ৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। চুন্নুকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এদের অনেককেই আইনি সহায়তার জন্য আদালতপাড়ায় সরকার দলের নেতারা আইনজীবীদের পিছনে দৌড়াতে দেখা যায়।

তবে এসব ছাড়িয়ে সবচেয়ে আলোচনায় চলে আসে গত ২ এপ্রিল ফতুল্লার মেরী আন্ডারসন নামক একটি ভাসমান বারে পুলিশ অভিযান দিয়ে ৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। ওই ঘটনায় একটি মামলায় দায়ের করে পুলিশ। মামলায় পুলিশ দাবি করে- অভিযুক্ত ১নং আসামী থেকে ২৫ নং আসামী পর্যন্ত সবাই জানায় এসব মাদক বিক্রয়ে সহযোগীতাকারী তানভীর আহমেদ টিটু। এই তানভীর আহমেদ টিটু এমপি শামীম ওসমানের আপন শ্যালক। ওই মামলার পর তানভীর আহমেদ টিটু দেশের বাহিরে চলে যান।

গত ২৯ মার্চ শামীম ওসমানের আরেক ঘনিষ্টজন মহানগর আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহনিজামের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেছিলেন তৎকালীন ওসি শাহ মোহাম্মদ মঞ্জুর কাদের। তার পরদিনই শাহ নিজাম দেশে ছেড়ে যান। দুই দিন পর ওসি মঞ্জুর কাদেরকে ঢাকায় এসবিতে বদলি করা হয়। পুলিশ প্র্রশাসন নিয়ে বিরুপ মন্তব্যের অভিযোগ তুলে শাহ নিজামের বিরুদ্ধে ওই জিডি করা হয়।

এদিকে গত ১৮ এপ্রিল বন্দর থানার একটি চাঁদাবাজি মামলায় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু ওরফে ডিস বাবুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওইদিন বিকেলে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে গিয়েছিলেন শামীম ওসমান। ডিস বাবুকের জন্য তদবিরও করেছিলেন। কিন্তু এসপি ডিস বাবুকে আদালতে পাঠিয়েছেন।

২৩ এপ্রিল মঙ্গলবার ডিস বাবুকে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাকে জেল গেটের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দেন। গ্রেপ্তারের পর ২১ এপ্রিল ফতুল্লা মডেল থানায় ডিস বাবুর বিরুদ্ধে আরও দুটি চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করেছেন মোক্তার হোসেন ও কুসুম নামে ক্যাবল ব্যবসায়ী

২৩ এপ্রিল মঙ্গলবার সকালে শামীম ওসমানের আরেক কর্মী সিদ্ধিরগঞ্জ যুবলীগের সভাপতি নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আগের দিন রাতে এক কোটি টাকা চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেন মডার্ণ অব কোম্পানী নামক একটি প্রতিষ্ঠানের ল্যান্ড এক্সিকিউটিভ আজমত আলীা।

এসব ছাড়াও শামীম ওসমানের একমাত্র ছেলে অয়ন ওসমানের শ্যালক বিকির বিরুদ্ধে গত ২৭ মার্চ একজন প্রবাসীর জমি দখলের অভিযোগে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা নিয়েছে পুলিশ।

এসবের সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকা থেকে শিশু সাদমান সাকি নিখোঁজের বিষয়টি। শিশুটির বাবা সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ওমর খালিদ এপন গত ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের বরাবর একটি লিখিত দিয়েছেন যেখানে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাজমুল আলম সজলের বিরুদ্ধে শিশুটিকে অপহরণের অভিযোগ তুলেছেন তিনি। এই নাজমুল আলম সজলও শামীম ওসমানের অন্যতম কাছের কর্মী। তিনি ওমরাহ পালনে চলে গেছেন। নাজমুল আলম সজল শহর স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাবেক সভাপতি।

আবার গত ২০ এপ্রিল ফতুল্লার ভূইগড়ে রূপায়ন টাউনে হামলার ঘটনায় দুটি মামলায় আসামী হয়েছেন জেলা কৃষকলীগের সভাপতি নাজিম উদ্দীন ভূঁইয়া। নাজিম উদ্দীন ভূঁইয়াও শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ কর্মী। তিনি সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদেও রয়েছেন। এর আগেও তার বিরুদ্ধে একাধিক ভূমিদূস্যতা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ ওঠেছিল। বর্তমানে তিনিও দেশের বাহিরে চলে গেছেন বলে বলে জানা গেছে।

এসব মধ্যে দু তিনটা ঘটনার পর গত ২ মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহরের ২নং রেলগেট এলাকায় সমাবেশের ঘোষণা দেন শামীম ওসমান। শামীম ওসমানের ওই সমাবেশের স্থলে পুলিশ জলকামান, সাজোয়া যান, আর্ম পুলিশ কার মোতায়েন করে রাখে পুলিশ। ওই দিন শামীম ওসমান জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস, ভূমিদস্যূ ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। একই সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাব্বী মিয়া ও জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদকে দেশের মধ্যে অন্যতম বেস্ট অফিসার হিসেবে মন্তব্য করেন।

এরপরও যখন শামীম ওসমানের শ্যালক ও তার লোকজনকে একের পর এক মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে তখন গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ এর উদ্যোগে একটি প্রতিবাদ সভা করা হয়। ওই সভা থেকে ৭ এপ্রিল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যবসায়ীরা ওই অভিযোগ দেননি। ওই দিন নারায়ণগঞ্জ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশের সাজোয়া যান, জলকামান, আর্ম পুলিশ কার মজুত দেখা যায়। জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে ওইদিন পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ শহরে মহড়া দিয়েছিলেন। মহড়া শেষে পুলিশ সুপার তার কার্যালয়ে এক ব্রিফিং এ বলেছিলেন, অপরাধীদের ছাড় দেয়া হবে না, সে যত বড় ক্ষমতাশালী লোক হোক। অভিযোন চলবে।’

এর পর গত ৬ এপ্রিল শামীম ওসমান ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের এক জরুরী কর্মী সভায় পুলিশ সুপারকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, প্লিজ ডোন্ট প্লে এই নারায়ণগঞ্জে। এখানে খেইলেন না। আমার লোকজনকে ফাঁসিয়ে, আমার আত্মীয়স্বজনকে মাদকের স্লালাইয়ার বানিয়ে আমাকে কাবু করা যাবে না, এটা মছিবত।’ ওইদিন শামীম ওসমানের লোকজন পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শ্লোগান দিয়েছিলেন। শামীম ওসমান বলেছিলেন, নারায়ণগঞ্জে খেলতে দেয়া হবে না। আগামী ১০/১২ দিনের মধ্যেই টের পাইবেন।’ শামীম ওসমানের এমন ঘোষণার ১২ দিনের মাথায় ডিস বাবুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

তবে এর আগে ৯ এপ্রিল বন্দরের লাঙ্গলবন্দে হিন্দু সম্প্রদায়ের স্নান উৎসবের বিষয়ে জেলা পুুলিশের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন শামীম ওসমানের বড় ভাই সদর আসনের এমপি সেলিম ওসমান। বৈঠকে সেলিম ওসমান বলেছিলেন, আজকের পর হয়তো বরফ গলবে।’ কিন্তু এসপি বলেছিলেন, আমাদের মাঝে কোন বরফই নাই, বরফ গলার প্রশ্নই আসেনা।’ এমপি সেলিম ওসমানকে সেদিন এসপি বলেছিলেন, আমরা যখন কোন তেল চোর, সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যূ, মাদক বিক্রেতা, জুয়ারীকে গ্রেপ্তার করবো তারা যদি আপনাদের লোক হয়, তাহলে কোন সমস্যা নাই। আমরা তাদের আদালতে পাঠাবো আপনারা অ্যাস পার ল, আদালত থেকে জামিন করিয়ে নিবেন। আইন সবার জন্য সমান।’