মনোনয়ন দাখিলেই কোণঠাসা নৌকা: আওয়ামীলীগ নেতাদের দাপট

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

নারায়ণগঞ্জের দুটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন দাখিলেই দেখা গেল স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামীলীগের নেতাদের দাপট। কিন্তু মনোনয়ন দাখিলের প্রথম দিন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা ছিলেন কোণঠাসা। জেলার আড়াইহাজার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাওয়া মুজাহিদুর রহমান হেলো সরকার আড়াইহাজারে মনোনয়ন পত্র দাখিল করতে পারেননি। তিনি মনোনয়ন দাখিল করেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে। অন্যদিকে সোনারগাঁও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোশারফ হোসেনের সমর্থকদের উপর হামলা চালিয়েছেন উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি মাহফুজুর রহমান কালামের সমর্থকেরা। এতে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।

জানাগেছে, আগামী ৩১ মার্চ সোনারগাঁ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সোমবার মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিনে সকাল থেকে আনন্দ মুখর পরিবেশে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েও বিকেলে বেলা নৌকার মনোনয়ন প্রার্থী মোশারফ হোসেন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহফুজুর রহমান কালাম মনোনয়নপত্র জমাকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী নেতাকর্মীরা জানান, মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিনে দুপুর ৩ থেকে ৪ টার মধ্যে নৌকার প্রার্থী মোশারফ হোসেনকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় বেধে দেওয়া হয়। নৌকা প্রতীকের মনোনিত প্রার্থী মোশারফ হোসেন সাড়ে ৩টায় উপজেলা মাঠে প্রবেশ করে সাবেক এমপি কায়সার হাসনাতের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত উপজেলা মাঠে অবস্থান করেন।

এদিকে, সাড়ে ৪টার দিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহফুজুর রহমান কালামও তার কর্মী সমর্থকরা মাঠে প্রবেশ করেন। এসময় নৌকার সমর্থকরা মাঠ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। স্বতন্ত্র প্রার্থী সমর্থকরা ঘোড়ার শ্লোগান দিয়ে মাঠ দখলের চেষ্টা করে। এতে উভয় পক্ষ মাঠ দখল করতে শক্ত অবস্থান নিলে শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ। সংঘর্ষে মোশারফ হোসেনের সমর্থক মোগরাপাড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সজিবসহ কয়েকজনকে পিটিয়ে আহত করে মাহফুজুর কালামের সর্থকরা। পরে পুলিশ লাঠি চার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।

এব্যাপারে নৌকার মনোনয়ন প্রার্থী মোশারফ হোসেন অভিযোগ করে বলেন, স্বতস্ত্র প্রার্থী কালামের লোকজন হামলা চালিয়ে আমার নেতাকর্মীদের আহত করেছেন। অপরদিকে মাহফুজুর রহমান কালাম অভিযোগ করেন, মোশারফ হোসেনের সর্থকরা আমার নেতাকর্মীদের উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে। এ ছাড়া বেশী কিছু আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাচন অফিসার ও সহকারী রিটানিং কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন জানান, সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণভাবে মনোনয়ন প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। বাহিরে কি হয়েছে সেটা আমি জানিনা।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ-৩(সোনারগাঁও) আসনে বর্তমানে এমপি হিসেবে রয়েছেন মহাজোটের এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা। সোনারগাঁও উপজেলা পরিষদে মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন। মোশারফ হোসেন হলেন আওয়ামীলীগের সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাতের আপন চাচা। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কায়সার হাসনাত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সিংহ প্রতীকে নির্বাচনে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের মাত্র একদিন আগে পুলিশ তার বাড়িতে হামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের মারধর করলে কায়সার হাসনাত নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান তিনি।

জাতীয় নির্বাচনের আগে মোশারফ হোসেন কায়সার হাসনাতের নির্বাচনী বেশকটি সভায় এমপি খোকার বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য রেখেছিলেন। এমনকি বলেছিলেন, এমপি খোকা আপনি হাওয়ার মাঝে ২০১৪ সালে বিনা ভোটে এমপি হয়েছিলেন। সোনারগাঁয়ে আপনার কোন ভোট নাই। আপনি বাড়িতে গিয়ে ঘুমান।’ গত ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে মনোনয়ন পান মোশারফ হোসেন। ওই নির্বাচনে সোনারগাঁও আসনটি আওয়ামীলীগ জাতীয়পার্টিকে ছেড়ে দিলে এখানে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় এমপি নির্বাচিত হন লিয়াকত হোসেন খোকা। গত নির্বাচনেও কায়সার হাসনাত নির্বাচন থেকে সরে গেলে এখানে এমপি নির্বাচিত হন খোকা। এ নির্বাচনে খোকার পক্ষে কাজ করেছিলেন সোনারগাঁও উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান কালাম। কালাম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি পাননি। এর আগে তিনি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দুইবার নির্বাচনে করে তিনি পরাজিত হয়েছেন।

অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন মুজাহিদুর রহমান হেলো সরকার। তবে ভোটের আগেই তিনি এলাকা ছাড়া। নির্বাচনে তিনি তার মনোনয়ন পত্র আড়াইহাজারের নির্বাচন কমিশন বরাবর দাখিল করতে পারেননি। সংঘর্ষের আশংকায় তিনি তার মনোনয়ন পত্র নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বরাবর দাখিল করেছেন।

৪ মার্চ মনোনয়ন পত্র দাখিলের শেষ বিকেলে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে এসে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দাখিল করেছেন মুজাহিদুর রহমান হেলো সরকার। এ সময় তার সঙ্গে মাত্র গুটিয়েকজন নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। তবে একই সময়ে আড়াইহাজার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শাহজালাল মিয়া মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন। মুলত শাহজালাল মিয়া স্থানীয় এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর ঘনিষ্ঠজন এবং মুজাহিদুর রহমান হেলো সরকার হলেন জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল পারভেজের অনুগামী হিসেবে রাজনীতি করছেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেলো সরকার এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে গিয়ে ইকবাল পারভেজের পক্ষে কাজ করেছিলেন। নৌকা প্রতীকে পেলেও মনোনয়ন পত্র দাখিলের সময় উপজেলা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি আবদুর রশিদ ভূইয়া সহ শীর্ষ নেতাদের কেউই উপস্থিত ছিলেন না।

আড়াইহাজার রেখে আপনি নারায়ণগঞ্জে এসে মনোনয়ন দাখিল করলেন কেন আপনি কি কোন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানতে চাইলে হেলো সরকার বলেন, আমি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে লড়াই করেছি।. এরশাদের সঙ্গে লড়াই করেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঢাকার রাজপথে প্রথম আমি মিছিল করেছি। আমি আবার কাকে ভয় পাবো? আমি কাউকে ভয় পাই নাই। আমি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক।

জানাগেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য মুজাহিদুর রহমান হেলো সরকার। তিনি এর আগে ভাইস চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি বর্তমান এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে গিয়ে জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল পারভেজের জন্য মনোনয়ন চেয়ে কাজ করেছিলেন। শুধু তাই নয় নজরুল ইসলাম বাবুর বিরোধী সরাসরি বক্তব্যও রেখেছিলেন হেলো সরকার।

এবারের নির্বাচনে নজরুল ইসলাম বাবু চেয়েছিলেন বর্তমান পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শাহজাহাল মিয়াকে। কিন্তু জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আবদুল হাই ও সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদ বাদল হেলো সরকারের পক্ষে সুপারিশ করে কেন্দ্রে নাম পাঠায়। ফলে এখানে মনোনয়ন ইকবাল পারভেজের ঘনিষ্টজন পান হেলো সরকার। তার মনোনয়ন ভাগিয়ে আনতে কাজ করেছিলেন ইকবাল পারভেজ।

আরও জানাগেছে, এর আগে আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেতে দৌঁড়ঝাপ করেছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের চার নেতা। দলটি থেকে একাধিক প্রার্থী হওয়ায় স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক কৌতুহল দেখা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কে হচ্ছে নৌকার মাঝি। মনোনয়ন পেতে লবিং করে ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান শাহজালাল মিয়া, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুর রশীদ ভূঁইয়া, থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিঞা মুহাম্মদ আলাউদ্দিন ও উপজেলা সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মুজাহিদুর রহমান হোলো সরকার।

অন্যদিকে উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা আগেই দিয়েছেন স্থানীয় নজরুল ইসলাম বাবুর ভাগিনা ও থানা যুবলীগের সহ-সভাপতি ইকবাল হোসেন মোল্লা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শরীফুল ইসলাম শরীফ। তবে আওয়ামীলীগ থেকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ও ঝর্ণা রহমানের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে ভাইস চেয়ারম্যান পদে কোন মনোনয়ন দিবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামীলীগ। ফলে এ দুটি পদে একাধিক প্রার্থী থাকতে পারবেন।