তারা ওসমান বিরোধী, দাড়িয়েছিলেন এক কাতারে!

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে ক্ষণে ক্ষণে ছিল নাটকীয়তা। মুলত নারায়ণগঞ্জে আওয়ামীলীগের রাজনীতি দুটি পক্ষে বিভক্ত। একদিকে এমপি শামীম ওসমান অন্যদিকে মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী। শহর কেন্দ্রীক রাজনীতিতে তাদের এই বিভক্তি ছড়িয়েছে জেলার প্রতিটি থানা এলাকায়। তবে গত নির্বাচনের পূর্বের রাজনীতিতে যারা বলয় ভিত্তিক রাজনীতি ছেড়ে নিজেদের অবস্থান নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন তাদের অনেকেই আবার আগের তল্পিবাহকের অবস্থানে ফিরে গেছেন। আবার কেউ কেউ নিজের একক অবস্থানে অটল রয়েছেন।

অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতিতে একাধিকবার সভাপতি ও সেক্রেটারি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এমপি শামীম ওসমানের বন্ধদের মধ্যে অন্যতম তিনি। এক সময় শামীম ওসমানের পাশেই ছিলেন রাজনীতিতে। বর্তমানে তার এক্ষেত্রে অনুপুস্থিতি। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠেছে তার। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশি ছিলেন। দলের মনোনয়নও কিনেছিলেন। ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠজন সেই সময় হয়েছিলেন ওসমান বিরোধী হিসেবে। এখনও তিনি তার অবস্থানে অটল রয়েছেন।

এমপি শামীম ওসমানের আরেক বন্ধু অ্যাডভোকেট খোকন সাহা। তিনি নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনিও গত নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৫ ও নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন থেকে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পত্র ক্রয় করেছিলেন। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে খোকন সাহার নামে কুৎসা রটিয়ে পত্রিকার ভেতরে লিফলেট ছড়িয়েছিলেন জেলা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদ বাদলের কর্মী গেরিলা আলমগীর। ওইদিন হকারকে ডেকে তার কালিরবাজারস্থলে চেম্বারে নিলে হকার গেরিলা আলমগীরের নাম সংবাদকর্মীদের সামনেই স্বীকার করে। এতে খোকন সাহা বিষয়টির জন্য শহীদ বাদলকে ইঙ্গিত করে দোষারোপ করেন।

এই বিষয়টি তার পরের সপ্তাহে আওয়ামীলীগ অফিসে খোকন সাহা ও শহীদ বাদলকে কোলাকুলি করিয়ে মিলিয়ে দেন নেতারা। তার পরের সপ্তাহে খোকন সাহা নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখলে মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন তাতে সম্মতি প্রকাশ করেন। এর দুদিন পর শহীদ বাদল আরেকটি সভায় খোকন সাহার নির্বাচনের মত প্রকাশ নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেন। পরবর্তীতে শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুও শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে চলে যান।

শহীদ বাদল নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে এবং তার সহধর্মিনী নাহিদা হাসনাত নারায়ণগঞ্জ-৪ যেখানে শামীম ওসমানের আসনেও মনোনয়ন ক্রয় করেছিলেন। পুরদস্তর তারাও ওসমান বিরোধী হয়ে পড়েন। সেই সঙ্গে আকার ইঙ্গিতে ওসমান বিরোধী বক্তব্য রাখেন। এমন পরিস্থিতিতে ওই সময় জাতীয় পার্টির এমপি সেলিম ওসমানও শহীদ বাদলকে ছাড় দেননি। শহীদ বাদল নারায়ণগঞ্জ কলেজের পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বে থেকে অর্থ আত্মসাতের মত বিষয়টিও অভিযোগ তুলেন। উপরোক্ত শীর্ষ এই তিন নেতাই হয়ে ওঠেছিলেন শামীম ওসমানের বিরোধী হিসেবে। তিনজনই চেয়েছিলেন নিজেদের দীর্ঘদিনের রাজনীতিতে কাজে লাগিয়ে নিজের অবস্থানের জানানি দিতে। কিন্তু তাদের কেউই মনোনয়ন পাননি।

অ্যাডভোকেট খোকন সাহার পাশাপাশি মহানগর আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহামুদা মালাও হয়ে ওঠেছিলেন ওসমান বিরোধী। যখন খোকন সাহা ও মাহামুদা মালাকে নিয়ে নানা ধরণের অকথ্য মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তখন মাহামুদা মালাও কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ করেন। এমন পরিস্থিতিতে খোকন সাহা ও মাহামুদা মালার ভয়েস রেকর্ড দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেএকটি অডিও রেকর্ড ফাঁস করা হয়। যা খোকন সাহা ও মালার বলে প্রচারণা চালালেও তারা দুজনই তাদের অডিও নয় বলে দাবি করেছিলেন। ওই অডিওতে শামীম ওসমানকে নিয়ে কিছু কথা ছিল। এদের মধ্যে দিপু তার অবস্থানে অনড় থাকলেও খোকন সাহা ও শহীদ বাদল আবারো শামীম ওসমানের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। মালাও মনোনয়ন ক্রয় করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে।

কাউসার আহমেদ পলাশ হলেন কেন্দ্রীয় শ্রমিকলীগের শ্রম কল্যাণ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক। তিনিও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে মনোনয়ন পত্র ক্রয় করেছিলেন। তিনি মুলত মেয়র আইভীর বলয়ে রাজনীতি করেন। নির্বাচনের পূর্বে তিনিও শামীম ওসমান বিরোধীতা করে নানা ধরণের বক্তব্য রেখেছিলেন। এমনকি তিনি সরকারি মনোনয়ন পত্র ক্রয় করলেও শেষপর্যন্ত তিনি মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেন।

অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি খেসারত দিয়েছেন সোনারগাঁও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান কালাম। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে মনোনয়ন পত্র ক্রয় করেছিলেন। কিন্তু দলের মনোনয়ন না পেলেও তিনি মহাজোটের প্রার্থী লিয়াকত হোসেন খোকার পক্ষেই কাজ করেছিলেন। সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী দাড়িয়েছিলেন সাবেক এমপি কায়সার হাসনাত।

ওই নির্বাচনের আগে এমপি শামীম ওসমানের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয় কালামের। বেশকটি কর্মসূচিতে মেয়র আইভীর পাশে দেখা যায় কালামকে। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি খোকার সুবিধার্থে শামীম ওসমানের কাছে আসেন কালাম। কিন্তু এর পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হন কালাম। সেই নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হন মোশারফ হোসেন যিনি কায়সার হাসনাতের চাচা। নির্বাচনের পর এবার উপজেলা আওয়ামীলীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল হাই ও সেক্রেটারি শহীদ বাদল। কমিটিতে সামসুল ইসলাম ভূইয়াকে আহ্বায়ক ও মাসুদুর রহমান মাসুমকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। এই কমিটিতে মুলত এমপি খোকার অনুকুলেই তৈরি করা হয়। আর এমপি খোকা হলেন এমপি শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন।

বর্তমানে সোনারগাঁও উপজেলা আওয়ামীলীগের কমিটি হারিয়ে এক হয়েছেন কায়সার হাসনাত, মোশারফ হোসেন ও কালাম। কিন্তু আহ্বায়ক কমিটি হলেও কমিটির নেতারা সোনারগাঁয়ে জায়গা করতে পারেননি। ইতিমধ্যে কায়সার ও কালাম পন্থী নেতাকর্র্মীদের তোপের মুখে পড়েছেন জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারি। ফলে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে ঘটেছে উলট পালট।