সোনারগাঁও মধুকুঞ্জ, মৌয়ালীর দল!

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

নারায়ণগঞ্জ জেলার ৫টি সংসদীয় আসনের মধ্যে সোনারগাঁও উপজেলা এলাকা নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন।  ২০০৮ সালের নির্বাচনে সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁও এলাকা নিয়ে ছিল নারায়ণগঞ্জ-৩।  ২০১৪ সালের নির্বাচনে সেটা বিভক্ত হয়ে আবারো সোনারগাঁও এলাকা নিয়ে গঠিত হয় এই আসনটি।  জেলার ৫টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে রাজনৈতিক আলোচনা সমালোচনা সোনারগাঁয়ের রাজনীতি নিয়ে।

বিশেষ করে এখানে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের মাঝে চেয়ার দখল-বেদখলের যে লড়াই, তাতে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই।  এই ক্ষমতা দখলের কামড়াকামড়িতে এ আসনটি আওয়ামীলীগ নেতাদের হাতছাড়া হয়েছে অনেক আগেই।  এরি মাঝে গজিয়েছে বহু কাউয়া হাইব্রিড, কিংবা বিদেশী প্রবাসী বিনদেশী আওয়ামীলীগারের।  রাজধানীর রাজনীতি থেকে সোনারগাঁয়ে এসে ঘাটি বসিয়েছেন অনেকে আওয়ামীলীগার, কেউ কেউ ঘাটি বসানোর চেষ্টায়।  তাহলে সোনারগাঁয়ের রাজপথের ত্যাগীদের কি হবে?

সোনারগাঁয়ের অলিগলি নিয়ন্ত্রণের লড়াই থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান সহ আগামীতে এমপি হওয়ার লড়াই শুরু হয়ে গেছে এখন থেকেই।  এমন লড়াইয়ের সুযোগে নিজেদের পাল্লা ভারি করতে কেউ কেউ ঠাঁই দিয়েছেন কাউয়া হাইব্রিডদের।  বর্তমান পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কাউয়া হাইব্রিডের চাপাচাপিতে বিএনপি-জামাত জোট সরকার আমলে হামলা মামলা নির্যাতনের শিকার হওয়া ত্যাগী নেতাকর্মীরা যেনো পালিয়ে বাঁচে।  কেউ কেউ লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখে।

এখানকার আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে কাউয়া হাইব্রিড কিংবা যারা বিএনপি-জামাত শিবিরের সঙ্গে রাজনীতি করতেন, কিংবা ওই সময়কার বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সমর্থক কিংবা সুবিধাঘেষা ছিলেন তারাও আজকে আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতাকর্মী হিসেবে সোনারগাঁয়ে আভির্ভূত হয়েছেন।  যারা ঢাকার রাজনীতিতে সুযোগ বুঝে দলে নাম লিখিয়েছেন তারাও এখন সোনারগাঁয়ে।  একইভাবে যারা কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন তারাও এখন সোনারগাঁয়ে ভীড় জমিয়েছেন।  কোনো কোনো নির্বাচন আসলে সেই ভীড় আরো বেড়ে যায়।  এখানে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার প্রবাসি বিনদেশীরাও আওয়ামীলীগের নেতা কিংবা নৌকা প্রতীক প্রত্যাশি হয়ে যান।  এখানকার আওয়ামীলীগ আবার পারিবারিক সূত্র থেকে পৌত্রিক সূত্র, এখন নতুন করে দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ ভাই কিংবা দুলাভাই, শ্যালক সম্বুন্ধী সূত্রেও আওয়ামীলীগার।  প্রবাসে বসেও এখানকার আওয়ামীলীগের পদ পাওয়া যায়, প্রবাসে থেকেও সোনারগাঁও আওয়ামীলীগ নেতা।

এমন পরিস্থিতিতে আবার নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগরীর নেতারাও সোনারগাঁয়ে এসে কিংবা জেলা মহানগরীতে বসেও ছড়ি ঘুরাতে পারেন।  জেলার শীর্ষ নেতাদের পদচারণাই সবচেয়ে বেশি সোনারগাঁয়ের অলিগলি।  জাতীয় নির্বাচনে এমন সব ব্যক্তিরা সোনারগাঁও থেকে নৌকার মনোনয়ন পত্র ক্রয় করেছিলেন যারা সোনারগাঁয়ের মাটির সন্তানও নয়, আবার সোনারগাঁয়ে কখনও রাজনীতিও করেননি।  যে কারনে গত নির্বাচনে জেলা পরিষদের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান মাসুম ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘সোনারগাঁও আসনটি গরীবের বউ, সকলের ভাবি।’ এখন আবার কেউ কেউ বলছেন, সোনারগাঁও মধুকুঞ্জ, এখানে ঢুকছে মৌয়ালীর দল, আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি।  মধুুকুঞ্জ থেকে যেমন মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করে ঠিক তেমন রাজনীতি এখন সোনারগাঁয়ে।

তবে এই মধুকুঞ্জ ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টায় নেমেছেন আওয়ামীলীগের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত ও সোনারগাঁও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান কালাম।  তারা কাউয়া হাইব্র্রিড ধমাতে একজোট হয়েছেন।  বিএনপি-জামাত জোট সরকার আমলের ত্যাগীদের এক কাতারে নিয়ে এসে কাউয়া হাইব্রিডকে প্রতিহত করে মধুকুঞ্জ ভেঙ্গে মেঘনায় ফেলার চেষ্টায় নেমেছেন।  তবে কাউয়া হাইব্রিডরা যে ঘাটি বসিয়েছেন সেটা সম্ভব হবে কিনা দেখার বিষয়।  কারন জেলা বা কেন্দ্রীয় অনেক নেতারাই এখন কাউয়া হাইব্রিডদের ‘ত্যাগী সার্টিফিকেট’ দিচ্ছেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদ বাদলকে বছরের বেশির ভাগ সময় সোনারগাঁয়ে দেখা যায়।  বিভিন্ন মিটিং মিছিল সভা সমাবেশ ঘরবৈঠক উঠানবৈঠক সামাজিক আচার অনুষ্ঠানেও তার পদচারণা।  ২০ আগস্ট শুক্রবার জামপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের আয়োজিত অনুষ্ঠানেও প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছেন জেলা আওয়ামীলীগ সেক্রেটারি!

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এই আসন থেকে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন প্রত্যাশা করে দলীয় মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করেছিলেন মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা।  তিনি সোনারগাঁয়ের রাজনীতিতে নাই ছিলেনও না।

জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক ডা. আবু জাফর চৌধুরী বিরু একই সঙ্গে হয়েছেন সোনারগাঁও উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য।  এই সরকার আমলে রাজনীতিতে এসেই তার বিরাট উত্থান।  জেলা পরিষদের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান মাসুম অভিযোগ তুলেছেন, ডা. বিরু ইসলামী ছাত্রশিবির করতো, তার পিতা স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন।  এ নিয়ে সোনারগাঁয়ে নিয়মিত তোলপাড় চলছে।  পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও চলছে নিয়মিত।

শিল্পপতি মনির হোসেন নেমেছেন সোনারগাঁও উপজেলা পরিষদের উপ-নির্বাচন নিয়ে।  তার ভাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেনের মৃত্যুর পর তিনি এখন রাজনীতির মাঠে আলোচনায়।  কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এতদিন কোথায় ছিলেন তিনি? এখন তিনি তার প্রয়াত ভাইয়ের কবরে গিয়ে মোনাজাতও করেন।  কিন্তু জীবিত অবস্থায় মোশারফ হোসেনের রোগমুক্তি কামনায় তো দোয়া মাহফিলও করেননি।  শোনা যাচ্ছে মোশারফ হোসেনের ছেলে তানভীর হোসেন তানহাও রাজনীতির মাঠে আসতে যাচ্ছেন।

ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল ইসলাম একজন ইংল্যান্ডের লন্ডন প্রবাসি।  নিজেকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য পরিচয়ে গত নির্বাচনে নৌকাপ্রতীকে মনোনয়ন প্রত্যাশি ছিলেন।  প্রবাসী সাংবাদিক আব্দুর গাফফার চৌধুরীও সোনারগাঁয়ে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন প্রত্যাশির নাম ঘোষণা করেছিলেন!

আনোয়ারুল কবির ভুঁইয়া নিজেকে একজন অর্থনীতিবিদ পরিচয় দিয়ে গত নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন প্রত্যাশি হিসেবে প্রচারণায় নামেন।  কিন্তু এখন হারিয়ে গেছেন।  শিল্পপতি এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন জেলা আওয়ামীলীগের শিল্প বিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন।  তার ছোট ভাই জাহিদ হাসান জিন্নাহ নৌকা প্রতীক নিয়ে সনমান্দি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান হয়েছেন।  প্রশ্ন আছে, কিন্তু তারা বিএনপি-জামাত সরকার আমলে কোথায় ছিলেন? তাদের কারনে রাজপথের ত্যাগী নেতা সাবেক চেয়ারম্যান সাহাবুউদ্দীন সাবু বঞ্চিতদের কাতারে।

সোনারগাঁযের রাজনীতিতে প্রবেশের চেষ্টায় কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের উপ-কমিটির সদস্য এইচএম মাসুদ দুলাল।  তিনিও মনোনয়ন প্রত্যাশি ছিলেন। একই সঙ্গে সোনারগাঁয়ের রাজনীতিতে না থাকলেও জেলা মহিলা লীগের সভাপতি প্রফেসর শিরিন বেগমও গত নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করেছিলেন।

রাজধানীর ইসলামপুুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান বাবুলও সোনারগাঁও উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য।  তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে বিএনপির পরিবার হিসেবে অভিযোগ ওঠেছে প্রায়শই।  কিন্তু সেটা বাদ দিলেও বিএনপি-জামাত সরকার আমলে বাবুল কোথায় ছিলেন? ওই সময় আওয়ামীলীগ করেননি কেন?

জাপান প্রবাসী আওয়ামীলীগ নেতা মাজহারুল ইসলাম মাসুমও সোনারগাঁয়ের রাজনীতিতে আলোচনায়।  ইটালি প্রবাসী মাহাবুব সরকার উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য পদে পদও হাকিয়েছিলেন।  যদিও সেটা পরবর্তীতে সমালোচনায় বাদ দেয়া হয়।  ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের পদধারী নেতা জাকির হোসাইন এখন সাদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী! ঢাকার শাহজাহানপুর থানা আওয়ামীলীগের সদস্য ছোবহান খন্দকারও এখন সোনারগাঁয়ের রাজনীতিতে।  প্রয়াত সংসদ সদস্য মোবারক রহমানের মৃত্যুর বহু বছর পর পুরোদস্তর পুরোদমে রাজনীতির মাঠে তার ছেলে এরফান হোসেন দ্বীপ।  কয়েক বছর ধরে সোনারগাঁয়ে তার পদচারণা জোরালো।  যদিও তার অনুগামীরা দাবি করেছেন তিনি বিএনপির আমলে সক্রিয় ছিলেন।