‘ষড়যন্ত্রমুলক’ মামলায় স্থায়ী জামিন পেলেন ‘সাহসী’ নেত্রী মৌসুমী

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

জিডিটাল নিরাপত্তা আইনে সোনারগাঁও উপজেলা ছাত্র সমাজ সভাপতি ফজলুল হক মাস্টারের দায়ের করা মামলায় স্থায়ী জামিন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় জাতীয় মহিলা পার্টির সাধারণ সম্পাদক অনন্যা হুসেইন মৌসুমী। তিনি জাতীয়পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পালিত কন্যা। গত ২০ নভেম্বর সোনারগাঁ থানায় মামলাটি দায়ের করেন স্থানীয় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকার অনুগামী কর্মী ফজলুুল হক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাজকে কেন্দ্র করে মৌসুমীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে এই মামলাটি দায়ের করা হয়। এই মামলাটি রাজনৈতিকভাবে ষড়যন্ত্রমুলক দাবি করেছেন অনন্যা হুসেইন মৌসুমী।

অনন্যা হুসেইন মৌসুমীর আইনজীবী নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট আলী আহাম্মদ ভূ্ইঁয়া জানান, ৬ ফেব্রুয়ারি বুধবার মামলায় হাজির দিয়েছেন মৌসুমী। গত ২৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে স্থায়ী জামিন লাভ করেন মৌসুমী। এর আগে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে তিনি নিম্ম আদালতে আত্মসমর্পন করেন।

এদিকে বুধবার সকালে আদালতে হাজিরা শেষে অনন্যা হুসেইন মৌসুমী বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমুলকভাবে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। মুলত আমাকে রাজনীতি থেকে সরাতেই এ মামলাটি দায়ের করা হয়। আমার বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্রই হোক আমি সোনারগাঁয়ের মানুষ ও মা বোনদের পাশে ছিলাম, যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন সকলের পাশে থাকবো। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে আদালতের নির্দেশ মত আমি নিম্ম আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেছি। আমাকে আদালত জামিন দিয়েছেন। নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছি।

মামলা সূত্রে জানাগেছে, অনন্যা হুসেইন মৌসুমীর নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে জাতীয়পার্টির তৎকালীন মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে ইঙ্গিত করে একটি স্ট্যাটাজ দেন ফেসবুক ব্যবহারকারী ব্যক্তি। এ নিয়ে গত ২০ নভেম্বর অনন্যা হুসেইন মৌসুমীকে অভিযুক্ত করে সোনারগাঁও থানায় একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি দায়ের করেন সোনারগাঁও উপজেলা ছাত্র সমাজের সভাপতি ফজলুল হক মাস্টার। ছাত্র সমাজের এই নেতা বর্তমান এমপি লিয়াকত হোসেন খোকার অনুগামী কর্মী হিসেবে পরিচিত। ওই মামলার পর দিন ২১ নভেম্বর সোনারগাঁও উপজেলা জাতীয়পার্টির ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করে জেলা জাতীয় পার্টি। এর আগে মৌসুমী সোনারগাঁও জাতীয় পার্টির সভাপতি ছিলেন। তাকে বাদ দিয়ে এই নতুন কমিটি গঠন করা হয়। অথচ তিনিই সোনারগাঁয়ের জাতীয়পার্টিকে প্রাণ এনে দিয়েছিলেন।

নেতাকর্মীদের সূত্রে জানাগেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এখানে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পান উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা মোশারফ হোসেন। জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পান বর্তমান এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার মহাজোটের শরীক দল জাতীয় পার্টিকে এ আসনটি ছেড়ে দিলে এখানে মোশারফ হোসেন তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় জাতীয় পাটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে এ আসনে মনোনয়ন নিয়ে কাজ করে আসছিলেন মৌসুমী। এমনকি মৌসুমীই পাবেন সোনারগাঁয়ে লাঙ্গলের মনোনয়ন এমন ঘোষণাও দিয়েছিলেন এরশাদ।

নেতাকর্মীরা বলছেন, সোনারগাঁয়ে মৌসুমীর শক্ত অবস্থানের কারনে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের বিশাল সমাবেশ করেছিলেন চেয়ারপারসন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও দুটি সমাবেশে এসে এরশাদ ঘোষণা করেছিলেন মৌসুমীকেই মনোনয়ন দেয়া হবে। কিন্তু ওই নির্বাচনেও তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। এরপরও তাকে মনোনয়ন দেয়ার আশ্বাস দিলেও এরশাদ তাকে মনোনিত করেননি। যা সোনারগাঁয়ের জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মাঝে এরশাদ তার ঘোষণার বিপরীত কাজ করায় তাকে নিয়েও বিরুপ মন্তব্য করেন নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। অথচ সোনারগাঁয়ে যাকে কেউ চিনতো না এমন একজনকে মনোনিত করে এমপি বানিয়েছেন এরশাদ।

এদিকে নেতাকর্মীরা আরও জানিয়েছেন, ৯০ দশক থেকে সোনারগাঁয়ে জাতীয়পার্টির রাজনীতির হাল ধরতে শুরু করেন মৌসুমী। গোলাম মসীহ নির্বাচন করলেও সেই নির্বাচনেও মৌসুমী কাজ করেছিলেন নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। কিন্তু নেতাকর্মীদের সঙ্গে গোলাম মসীহের সম্পৃক্ততা না থাকায় মাত্র দশ হাজারের নিচে ভোট পান তিনি। পরবর্তীতে তিনি অনেকটা পালিয়ে যান সোনারগাঁও থেকে। ছাত্র সমাজের এই ফজলুল হককে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন মৌসুমী। ছাত্র সমাজের নেতা হয়েছেন যার মাধ্যমে সেই মৌসুমীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করায় ফজলুল হককে নিয়ে সোনারগাঁয়ের নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়।

২০১৪ সালের ওই নির্বাচনের আগে সোনারগাঁয়ের এ আসনটিতে অপরিচিতই ছিলেন এমপি খোকা। সোনারগাঁয়ের নেতাকর্মী তো দুরের কথা সোনারগাঁয়ের মানুষও তাকে চিনতেন না। জাতীয়পার্টির সাবেক এমপি আনম বাহাউল হক যখন জাতীয়পার্টি থেকে আওয়ামীলীগে চলে যান তখন থেকে জাতীয়পার্টির অবস্থান নড়বড়ে হতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ২০০১ সালে জাতীয়পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন জাতীয়পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গোলাম মসীহ। ওই নির্বাচনের পর গোলাম মসীহ সোনারগাঁয়ের জাতীয় পার্টির কোন হাল ধরেননি। জাতীয়পার্টির যখন দৈনদশা তখন এখানকার জাতীয় পার্টির হাল ধরে ছিলেন মৌসুমী। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী সংগ্রহ ও কমিটি গঠন করেছিলেন তিনি। সোনারগাঁয়ে নারী সমর্থকদের ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মৌসুুমী। অথচ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সেই নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পাননি।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর উপজেলা জাতীয়পার্টির কার্যালয়ে হামলার শিকার হন মৌসুমী। হামলার শিকার হয়ে তিনি থানায় লিখিত অভিযোগও করেছিলেন। কিন্তু মামলা গ্রহণ করা হয়নি। তারপর থেকে তিনি কেন্দ্রীয় জাতীয়পার্টির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। প্রায় সাড়ে ৪ বছর তিনি সোনারগাঁয়ে রাজনীতিতে অনেকটা দুরে থাকলেও সোনারগাঁয়ের নেতাকর্মীদের খোজ খবর রেখেছেন নিয়মিত। সোনারগাঁয়ের নেতাকর্মীদের নিয়ে ঢাকায় জাতীয়পার্টির কর্মসূচিগুলো করেছেন ঢাকায় থেকেই। পরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ৭ সেপ্টেম্বর তিনি সোনারগাঁয়ে নির্বাচনী মাঠে নামেন। প্রতিদিন তার সোনারগাঁয়ের নেতাকর্মীদের নিয়ে লাঙ্গলের পক্ষে গণসংযোগ করে জোড়ালো অবস্থান তৈরি করেন। এরি মাঝে তিনি মামলায় আসামী হয়ে যান।

গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে মনোনয়ন পান লিয়াকত হোসেন খোকা। আবারও এখান থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হন মৌসুমী। সোনারগাঁয়ে জাতীয়পার্টির রাজনীতিকে সচল রাখা মৌসুমীর ভাগ্যে জুটেনি দুইবারই মনোনয়ন। এবারও এমপি নির্বাচিত হন লিয়াকত হোসেন খোকা। এদিকে জাতীয় পার্টি থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন চেয়েছেন মৌসুুমী। সোনারগাঁয়ের মানুষ এখন তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাজনৈতিকভাবে হোচট খেলেও রাজনীতিতে এখনও সক্রিয় থাকায় তাকে সোনারগাঁয়ের নেতাকর্মীরা বলছেন ‘সাহসী’ নেত্রী।