চলমান প্রক্রিয়ায় গরীব হচ্ছে নিঃস্ব, ধনীরা হচ্ছে বিত্তশালী

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

করোনা মৃত্যুর পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অন্যান্য মৃত্যুর মিছিল, লঞ্চ ডুবি পূর্বেও ছিল, এখনো আছে, কিন্তু কোন তদন্ত প্রতিবেদন এখনও পর্যন্ত আলোর মূখ দেখে নাই বা তদন্তের আলোকে ফলপ্রসু কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা তাহাও জনগণ জানে না। তবে এ বারে পোস্তখোলার লঞ্চ দূর্ঘটনাকে নৌ প্রতিমন্ত্রী হত্যা বলে মন্তব্য করেছেন, এখন দেখা যাক হত্যাকারী এবং দায়িত্ব পালনে অবহেলাকারী সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কি পরিমাণ শাস্তি কার্যকর হয় (!) মাদক কারবারী বা চিহ্নিত সন্ত্রাসী এনকাউন্টারে মৃত্যু এবং প্রতিনিয়ত বর্ডার এলাকায় ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যার সংবাদ সমভাবে, সমমেজাজে দেশবাসী গ্রহণ করে না। কারণ বর্ডারে বাঙ্গালী হত্যা (যার প্রতিবাদ শুধু ফ্লাগ মিটিং এ সীমাবদ্ধ) প্রতিটি দেশবাসীর মন মগজে বজ্রপাতের মত আঘাত হানে। বিনা পাসপোর্টে বর্ডার ক্রস করলে কোন দেশে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়? কোন ব্যক্তি যদি বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করার চেষ্টা করে তখন তো কোন ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড গুলি করে হত্যার সংবাদ শোনা যায় না। হৃদয় নিংরানো স্বাধীনতা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায় যখন বর্ডার এলাকায় বাংলাদেশীকে ভারতীয় বাহিনী ঠুনকো অজুহাতে আমাদের নাগরিকদের হত্যা করে। কোন কারণেই কালো বাজার, স্মাগলিং বা অবৈধ পন্থায় বর্ডার ক্রসকে সমর্থন করা যায় না, কিন্তু এর অর্থ কি বর্ডার ক্রস করলেই হত্যার জন্য গুলি? এর জন্য অন্য কোন বিচার ব্যবস্থার বিধান চালু করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কি কোন প্রকার দ্বায় দায়িত্ব নাই?

অধিকন্তু মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছে “বজ্রপাত”, যার উপরও বিজ্ঞানীদের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই। তবে পবিত্র কোরান শরীফে এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। গত তিন বৎসরে বজ্রপাতে মৃত্যু সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মিডিয়ার তথ্য মতে চলতি বছর জুনের প্রথম সপ্তাহ গণমাধ্যমের তথ্য মতে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০ এর কাছাকাছি। এপ্রিলে ২১ জন হলেও শুধু মে মাসের এক-তৃতীয়াংশ সময়ে মারা গেছেন শতাধিক মানুষ। ২০১৮ সালের এপ্রিলে মারা যান ৭৬ জন। ২০১৭ সালের একই সময়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩২ জন। এর আগের বছর ছিল ৪৩ জন। ওই বছর প্রায় ৩৫০ জন মারা যাওয়ায় সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করলেও (সূত্র: জাতীয় পত্রিকা, তাং- ০৭/০৭/২০২০ ইং) বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রস্তুতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। শোনা দিয়েছিল যে, এজন্য তালগাছ বিভিন্ন এলাকায় রোপন করা হবে। কিন্তু পদক্ষেপ এখনো নেয়া হয় নাই।

“মরার উপর খাড়ার ঘা” হিসাবে সরকারের এক নতুন ঘোষনা জনগণের উপর আর্ভিরভুত হয়েছে। ঘোষনাটি হলো করোনা টেষ্ট করাতে জনপ্রতি ২০০/- এবং বাড়ীতে যেয়ে টেষ্ট করালে জনপ্রতি ৫০০/- টাকা ফিস দিতে হবে। পৃথিবীর অন্য কোন রাষ্ট্রে করোনা পরীক্ষা করার ফিস নির্ধারণ করা হয়েছে কি? মিডিয়াতে এ মর্মে কোন সংবাদ চোখে পড়ে নাই। তবে পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ বা ভারতে নাগরিকদের অর্থনৈতিক অবস্থান চিন্তা করলে তা বিবেক সম্পন্ন হবে না। কারণ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দারিদ্রতার অভিশাপে জর্জরিত। যাদের “নুন আনতে পানতা ফুরায়” তাদের পক্ষে কি ২০০/- টাকা ফিস দিয়ে করোনা পরীক্ষা করার জন্য কি কেহ এগিয়ে আসবে? উপরোক্ত আদেশে সাধারণ দীনমজুর খেটে খাওয়া মানুষদের করোনা টেষ্ট করাতে নিরুসাহিত করা হয়েছে। সরকারের অবশ্যই বুঝা উচিৎ ছিল যে, আমাদের দেশের কত পারসেন্ট লোক সমাজ বা স্বাস্থ্য সচেতন? এতো প্রচার প্রবাকান্ডার পরেও মিডিয়া খুললেই দেখা যায় যে, শত হাজার লোক মাক্স ছাড়াই বাজারে, রাস্তা ঘাটে ঘুরা ফিরা করছে। সংক্রামক ঠেকাতে হলে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে করোনা টেষ্ট করানো দরকার। নতুবা গোপনভাবে করোনা সংক্রামিত হতেই থাকবে। কারণ কিছু করোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছে যার কোন প্রকার উপসর্গ না থাকলেও করোনাতেই মৃত্যু বরণ করছে। সচেতন থেকে চিকিৎসকরা যেখানে মৃত্যুবরণ করছে, সুস্থ্য সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া স্বত্বেও পুলিশ যেখানে সংক্রমিত হচ্ছে, সেখানে খেটে খাওয়া মানুষ দ্বারা গোটা দেশবাসী সংক্রমিত হওয়ার সম্ভবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সরকারের উচিৎ হবে ২০০/৫০০ টাকার বিনিময়ে করোনা চেষ্ট পদ্ধতি উঠিয়ে দেয়া। অন্যথায় এ দায়ভার সরকারকেই ভোগ করতে হবে। সরকার যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রনয়ন করেছে সেখানে ফি নিয়ে করোনা টেষ্টের সিদ্ধান্ত একটি হ্যাসরসমূলক ঘটনা বটে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলতেন, “গরীব নেহি, গরীবি হটাও, কিন্তু এখন চলছে গরীব হটানোর অদৃশ্য প্রকল্প। মানুষ কি পরিমান গরীব হলে নিজের কিডনী বিক্রি করে? একটি জেলার একই এলাকায় ১৬ জন ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করেছে, যার সংবাদ চাউর হওয়ার পর হয়েছে মামলা। কিডনি বিক্রয় প্রবনতার হিরিক রোধ করার জন্য হাই কোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন, শুধুমাত্র নিকট আতœীয়কে কিডনি দেয়া যাবে। স্বেচ্ছায় কিডনী দিয়ে কোন স্বজনকে যদি বাঁচানো যায়, তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নহে, কিন্তু আপত্তি উঠে সেখানেই যখন সরকার বলে যে, বাংলাদেশ গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে (!) যদি তাই হয় তবে কেন এদেশের মানুষ ক্ষুদার জ্বালা মিটাতে কাঠের নৌকায় বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে সাগরেই শলিল সমাধি হচ্ছে? পিতা/মাতা তাদের শিশু সন্তানদের গলাটিপে হত্যা করছে। এর পিছনে কি শুধু পারিবারিক কলহ দায়ী, না কি অভাব অনটন থেকে এ হত্যার সূত্রপাত। যে পরিবারে দু’বেলা অন্ন জোটেনা সে পরিবারে বিবাদ কলহ ছাড়া আর কি থাকতে পারে?

প্রতিটি সিগনালে গাড়ী থামলে যখন অসহায় ভিক্ষুকদের দেখি তখন রাজধানীর চাকচিক্য ম্লান হয়ে যায়। জুম্বার নামাজে প্রতিটি মসজীদের সামনে ভিক্ষুকদের জটলা যাদের হাড্ডীসার বদন এবং ক্ষুদার্থ চেহারা দেখলে সরকারের প্রচারিত “উন্নয়নের চেহারা” কালো ছায়ায় ঢেকে যায়। সরকার এ ধরনের কথা প্রচার করে নিজেদের মূখ রক্ষার জন্য, কিন্তু সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবিরা প্রচার করে বহুগুনে শুধুমাত্র সরকারের কিছু বদনত্যায় প্রত্যাশায়। তবে তাদের এ প্রত্যাশা বিফলে যায় নাই, কাধে ঝুলানো ব্যাগ ছেড়ে এখন তারা পাজারো গাড়ীতে চড়ে। বুদ্ধিজীবিরা জাতির বিবেক, তারাই যখন স্বার্থ হাসিলের জন্য বিক্রি হয় তখন ভুক্তভোগী মানুষেরা তাদের ভাগ্য বিড়ম্বনাকে নিয়তির খেলাই মনে করে। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বন্টনে প্রতিটি নাগরিকের অংশীদারিত্বের দাবী জনগণ মনে করে না, যা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি। তবে সে প্রতিশ্রুতি একেবারে বিফলে যায় নাই, কারণ একটি শ্রেণী একক ভাবে ধনী হয়ে, এখন তাদের কেহ কেহ ইতোমধ্যে বিত্তশালী হয়েছেন, বাকীরা রয়েছে প্রতিযোগীতায়, কার আগে কে শত কোটি টাকার মালিক হতে পারবে। যার পিছনে রয়েছে ব্যাংক লুট, মানি লন্ডারিং, বিদেশে রাজ প্রসাদ নির্মাণ প্রভৃতি। অনেকেরই পরিবার এখন বিদেশে নিজস্ব প্রাসাদে বসবাস করে, বেগম পাড়া নামে বাংঙ্গালী ধনী ললনাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা বিদেশে রয়েছে। বেশী কথা বলে এমন একজন উচ্চ পদস্থ সরকারী ঘরনার রাজনীতিবিদ (বিনা ভোটে নির্বাচিত এম.পি) দেশে করোনা দু:সময়ে পাড়ি জমিয়েছে কানাডায়, তার জবানীতেই দেশবাসী জানতে পারলো তার পরিবারবর্গ কানাডায় থাকে, অথচ মূখে যখন তার খৈ ফুটতো তখন বুঝা যেতো যে তার চেয়ে দেশ প্রেমিক আর কেহ নাই।

সরকার পাটকল শ্রমিকদের Golden Hand Shake এর মাধ্যমে বাধ্যতামূলক চাকুরী থেকে বিদায় করে পাবলিক প্রাইভেট যৌথ অংশীদারীত্বে পাটকল পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাট শ্রমিকদের দাবী বড় বড় আমলাদের চুরি ও দূর্নীতির কারণে পাট কলে লোকশান হচ্ছে। সরকারী প্রেস নোট মোতাবেক লোকসান দিয়ে দীর্ঘদিন পাট কল ইন্ডাষ্ট্রিজ সরকারের পক্ষে চালানো সম্ভব নহে। সরকার প্রধান সরকারী আমলাদের পুকুর চুরির ঘটনা নিশ্চয় তিনি জানেন। “পার” কেটে বিল কাটার খরচ তুলে নেয়া, সরকারী হাসপাতালে ডাক্তার নার্সদের খাওয়ার খরচ ২০ কোটি টাকার কথাও তিনি (প্রধানমন্ত্রী) উল্লেখ করে তদন্ত করবেন বলে জানিয়েছেন। সরকার আমলাদের চুরি বন্ধ করতে পারছে না এবং এর পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। কারণ সরকার যখন আমলা নির্ভর হয়ে পড়ে তখন চোখের সামনে চুরি হলেও সরকার নির্বাক হয়ে যায়, যেহেতু আমলারাই সরকার টিকিয়ে রখেছে বলে একটি পাবলিক পারসেপশন বাজারে চালু আছে, যার সত্যতাও অবশ্যই রয়েছে।

প্রাইভেট পাবলিক যৌথভাবে পাটকলগুলি চালানোর সরকারের যে যুক্তি তা একটি শুভঙ্করের ফাকি মাত্র। প্রাইভেট অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানা। এ জুট মিলগুলি এখন ব্যক্তি পর্যায়ে বিক্রি করা হবে যাদের টাকা আছে তারাই Book Money দিয়ে পানির দরে মিলগুলি কেনার সুযোগ পাবে। বিত্তশালীদের “অলস” টাকা (Idle Money) বা কালো টাকা ব্যবহারের একটি সূযোগ সরকার করে দিলো। ফলে টাকা ওয়ালারা আরো বিত্তশালী হবে বটে, কিন্তু পাটকল শ্রমিকদের পরিবারগুলি নিঃস্ব হয়ে যাবে। গত ২০ বৎসর পূর্বে যে ব্যক্তি ১০ বিঘা জমির মালিক ছিল, সংসারের ঘানি টানতে যেয়ে জমি বিক্র করে নিঃস্ব হয়েছে এবং যে ২০০ বিঘা জমির মালিক ছিল সে হয়েছে ৫০০ বিঘা সম্পত্তি। এমনিভাবে বিভিন্ন সেক্টর ওয়াইজ গরীবকে নিঃস্ব, অন্যদিকে ধনীদের আরো বিত্তশালী করার অদৃশ্য পরিকল্পনা এগিয়ে যাচ্ছে।

অর্থ উর্পাজনের জন্য মানুষ বিশেষ করে ধনী ব্যক্তিরা (যারা সমাজে বিভিন্ন ভাবে প্রতিষ্ঠিত) লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে অসচ্ছ ও অসাধু প্রতিযোগীতায় নেমেছে। হাসপাতাল চালু করেছে সেবার উদ্দেশ্যে নহে, বরং মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিংরানোর একটি ফাদ পাতা হয়েছে। ভাবতে খুবই আশ্চর্য লাগে যে, করোনা ভাইরাসের ভূয়া নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়ে টাকা আদায় করে নিচ্ছে। তবে কি টাকা কামানোর প্রতিযোগীতায় মানুষ পশুর চেয়েও নীচে নেমে গেলো (!) ডাকাত ডাকাতি করে, চোর চুরি করে সমাজে ডাকাত বা চোর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এ রক্ত পিপাসুদের সমাজ কোন বিশ্লেষনে চিহ্নিত করবে?

সম্পদের সুষম বন্টনের দাবীতে স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন যা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন করতে রাষ্ট্র পুরোপরি ব্যর্থ হয়েছে, সংবিধানে ঘোষিত নীতিমালা রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করতে পারে নাই, কিন্তু এর দায়ভার বহন করতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে এবং এ ট্রেজিডি এখন জনগণের গা সয়া হয়ে পড়েছে যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি অশ্বনি সংকেত।

লেখক: তৈমূর আলম খন্দকার

রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবী (এ্যাপিলেট ডিভিশন)