রাজনীতির সব রঙ মিশে তৈরি হোক মানবিকতা

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

সারা বিশ্ব আজ নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারী মোকাবেলায় বিপর্যস্ত, উন্নত বিশ্ব প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেও মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারছে না। বরং বিশ্বের অনেক সরকার তাদের জনগণের জীবন বাঁচানোর জন্য আজ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে ইউরোপ, কানাডার জন্য আনা মাস্কের শিপমেন্ট তারা জব্দ করেছে। বলা হচ্ছে, মাস্কের এই বিশাল চালান থাইল্যান্ড থেকে ছিনতাই করে নিয়েছে আমেরিকা। এ অভিযোগ খোদ ইউরোপ ও কানাডার। আমেরিকা বলছে, তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি আইনের প্রয়োগে এর মূল্য পরিশোধ করে নিয়েছেন।

এদিকে ইন্ডিয়ায় উৎপাদিত ম্যালেরিয়ার একটি ওষুধ রপ্তানি জন্য অনুরোধ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু ভারত রাজি হচ্ছিল না। এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি-ধামকি দিয়ে রাজি করিয়েছেন। ট্রাম্পকে এসব করতে হয়েছে তার দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য।

আমরা যদি দেখি উন্নত বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশেই মেডিকেল ইকুইপমেন্ট রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তারা এসব করতে বাধ্য হয়েছে দেশ ও জনগনের কথা বিবেচনা করে। বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের দেখা যাচ্ছে তাদের দেশের জনগণকে এবাদত করতে বলছে। তারা সৃষ্টিকর্তার সাহায্য প্রার্থনা করছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী আকাশের মালিকের কাছে সমাধান চেয়েছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সরকার কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে দিয়েছেন।

নৌ-বাহিনীতে যথাযথ নিরাপত্তা দিতে না পারায় মার্কিন নৌবাহিনী বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী থমাস মোডলি পদত্যাগ করেছেন। মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস থিওডোর রুজভেল্টে করোনা ভাইরাসের মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে সমালোচনা করেন ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন ব্রেট ক্রোজিয়ার।এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বরখাস্ত করার ঘটনায় মন্ত্রী মোডলি পদত্যাগ করলেন।

আর জার্মানির একটি প্রাদেশিক অর্থমন্ত্রী করোনার পরবর্তী অর্থনীতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আত্মহত্য করেছেন। পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী রাতে খাদ্যসামগ্রী নিজ কাঁধে নিয়ে জনগণের মধ্য বিলিয়েছেন। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারী মোকাবেলায় পুনরায় চিকিৎসা পেশায় ফিরেছেন আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডা. লিও ভারাদকার। উন্নত বিশ্বের সরকারগুলো প্রতিটি নাগরিকে করোনার পরীক্ষা এবং সর্বাধুনিক সুচিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে তাদের নাগরিকদের বাঁচানোর জন্য।

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে নিউজিল্যান্ডে চলছে লকডাউন। আর সেই লকডাউন না মেনে পরিবার নিয়ে গাড়ি চালিয়ে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পরে অবশ্য ভুল বুঝতে পেরে নিজেই নিজেকে ‘নির্বোধ’ বলেছেন তিনি।

বিবিসির খবরে জানা যায়, দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডেভিড ক্লার্ক স্বীকার করেছেন, ২০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে সৈকতে যাওয়াটা ছিল লকডাউনের পুরোপুরি লঙ্ঘন। তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডানের কাছে পদত্যাগপত্র দিতে চেয়েছেন। সংকটময় পরিস্থিতির জন্য তাকে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মন্ত্রিসভার পদমর্যাদা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সহযোগী অর্থমন্ত্রীর পদও তিনি হারিয়েছেন

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী-এমপিরা জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন। তারপরও তারা থেমে নেই।

তুরস্ক তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে ইতালিতে, স্পেনে ও সার্বিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও পাঁচটি বলকান অঞ্চলে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তৃতীয় বিশ্বের জন্য ১৬.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারী মোকাবেলায় সাহায্যের ঘোষণা করেছে। যেসব অঞ্চলে যুদ্ধ চলছে, গৃহযুদ্ধ চলছে বা সন্ত্রাসী আক্রমণ চলছিল, আজ তারা যুদ্ধবিরতিতে।

সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে হাউথি আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াইরত। তারাও দুই সপ্তাহের যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেছে। অথচ এই যুদ্ধের প্রভাবে ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষে শিশুসহ লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছে। সিরিয়ায় দীর্ঘ প্রায় ১০ বছরের যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নিরিহ মানুষের মৃত্যু এবং লক্ষ লক্ষ নিরিহ মানুষ গৃহহারা হয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে সিরিয়ার শিশুটি কাঁদতে কাঁদতে বলছে- আমি আল্লাহকে সব বলে দেবো। বিশ্ববাসী কি এই নির্মমতা দেখে নাই? ফিলিস্তিন, বার্মা, ইন্ডিয়া, চীনের, ইরাক, লিবিয়া, উইঘুর সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের উপর নির্যাতন আজকে বন্ধ। এক মানবিক বিশ্বের নতুন রূপ দেখছি আজ।

সবই তো রাজনীতি, মানবতার রাজনীতি, সন্ত্রাসের রাজনীতি বা স্বৈরাচারের রাজনীতি।

বাংলাদেশ এই পৃথিবীর মানচিত্রের বাইরে নয়। বাংলাদেশেও বাড়ছে করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারির প্রাদুর্ভাব। প্রতিদিন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছে মানুষ। জ্বর,সর্দি ঠান্ডায় বা করোনাভাইরাসের উপসর্গে মৃত্যু হচ্ছে এবং এই অগণিত মৃত্যু যা পৃথিবী থেকে একটু ভিন্ন রকম। দীর্ঘ তিন মাস বাংলাদেশ সময় পেয়েছে, কেন এখনো প্রতিটি সন্দেহজনক মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনা হলো না।

সরকার কার্যত শুধু লকডাউন ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি। এটা হচ্ছে বৈশ্বিক সমস্যা। এই মহামারিতে তো কারো হাত ছিল না যে এটা লুকোনোর কোন বিষয়। বরং প্রথম থেকেই কার্যকর ব্যবস্থা নিলে হয়তোবা এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এখন পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে মরে যা থাকে। সরকারের অভিযোগ, সারা বাংলাদেশে এখন করোনা আতঙ্ক আর গুজব চলছে।

সরকারের এবক্তব্যের সাথে আমি একমত নই। কারণ এ পর্যন্ত ৪৮২ জন আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের দেশে এটি নতুন রোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে- সত্যকে গোপন রাখতে সব কিছু গুজব বলে উড়িয়ে দেয়া। কেউ অপছন্দের কিছু করলে বা খারাপ কিছু করলেই মানুষ তিরষ্কার দেয়, এই বলে রাজনীতি করো না বা রাজনৈতিক রং দিও না।

বাংলাদেশের রাজনীতি কতটা নিন্দনীয় মানুষের কাছে। অথচ বিশ্বে এই রাজনৈতিক নেতৃত্বেই আজকে করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। চলছে কর্মহীন মানুষের জীবিকা চলার বন্দোবস্ত। তাহলে উন্নত বিশ্বের মানবিক রাজনীতি আর আমাদের স্বার্থান্বেষী রাজনীতির মধ্যে অনেক তফাৎ অনেক ফারাক আছে। রাজনীতি হতে হবে দেশের জন্য, মানুষের জন্য। কিন্তু সে রাজনীতি কি আমাদের দেশে আছে?

এর যথেষ্ট কারণও আছে। আজে এই সঙ্কটের মধ্যেও ত্রাণের চাল/ডাল লুট হচ্ছে। প্রতিদিন এ ধরনের লুটের খবর আসছে। বিশ্বে এমন মহামারি আর আমাদের দেশে চলছে চাল চুরি, লোক দেখানো ত্রাণ বিতরণের সেলফিবাজি আর সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের লাগামহীন কথাবার্তা। এগুলো মানুষকে আরও ভাবিয়ে তুলেছে। এই মহাবিপদ থেকে উত্তরণের জন্য সুস্থ রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই।

এই মহামারীর সময় আমাদের এক হয়ে কাজ করতে হবে। এখন দরকার জাতীয় সমন্বয় কমিটির। সব দল মত নির্বিশেষে সব ভুলে এক হওয়ার উপযুক্ত সময়। জাতির এ সংকটকালে বিএনপিও ইতোমধ্যে সরকারের সাথে কাজ করার কথা জানিয়েছে। এখন দরকার জাতীয় ঐক্য। যা আমাদের অনেক সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে।

আমাদের এখন প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি। আমাদের মাঝে ফিরে আসুক সুস্থ রাজনীতি, আমাদের মাঝে ফিরে আসুক শুভবুদ্ধি, হিংসা-বিদ্বেষ, দলাদলি ভুলে হয়ে উঠি মানবিক। সব রাজনৈতিক রং মিশিয়ে আমরা একটা রঙে রঙিন হই – মানবিক রঙে। রাজনীতির সব রঙ মিশে তৈরি হোক মানবিকতা।

লেখক: মাহমুদুর রহমান সুমন
কলামিস্ট ও রাজনীতিক