সেলিম ওসমানের প্রশ্ন, শ্রমিক নেতারা কোথায়?

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

নারায়ণগঞ্জে একের পর এক জায়গা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে এমপি সেলিম ওসমান বলেছেন, এ ব্যাপারে শিল্প পুলিশ কিছুই জানে না এবং নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক নেতারাও এ ব্যাপারে কোন কথা বলছেন না।

২৬ অক্টোবর শনিবার সকাল ১১টায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী ইপিজেড এলাকায় শিল্প পুলিশ নারায়ণগঞ্জের কার্যালয়ে কমিউনিটি পুলিশিং ডে-২০১৯ উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এমন অভিযোগ তুলেন।

এ সময় মঞ্চে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- শিল্প পুলিশ হেডকোয়াটার (উত্তরা) এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন, শ্রমিক নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি আব্দুল মতিন মাস্টার, বাংলাদেশ ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কস এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কাউসার আহম্মেদ পলাশ। এর আগে নারায়ণগঞ্জ-সিদ্ধিরগঞ্জ-ডেমরা সড়কে র‌্যালীতে অংশ নেন এমপি সেলিম ওসমান সহ বিকেএমইএ নেতৃবৃন্দরা।

উক্ত সভায় তিনি নারায়ণগঞ্জ শিল্প পুলিশের সদস্যদের থাকার সু-ব্যবস্থা করতে সোনারগাঁয়ের কাচপুরে একটি ডরমেটরি নির্মাণের জন্য ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ১৮৯ টাকার চেক শিল্প পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। শিল্প পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নীট গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএ এর পক্ষ উক্ত চেকটি প্রদান করা হয়।

সভায় বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান বলেন, শিল্প পুলিশের কমিউনিটি পুলিশিংয়ের এমন আলোচনা সভা বছরে একবার নয়। আমি মনে করি বিকেএমইএ, শিল্প পুলিশ ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দদের সমন্বয়ে প্রয়োজনে জেলা পুলিশ, র‌্যাব কে একটি কমিটি গঠন করে বছরে অন্তত ৪টি সভার আয়োজন করা যেতে পারে। এতে করে ঈদের আগে বেতন বোনাস পরিশোধ, ছুটি কতদিন এবং কিভাবে হবে সব কিছু আগে থেকেই ঠিক করে রাখা সম্ভব হবে। তাহলে দেখা যাবে ঈদের আগে যেমন সবার মাঝে একটি অস্থিরতা তৈরি হয় সেটি আর দেখা যাবে না।

নীট ওয়্যার পন্য রপ্তানির ব্যাপারে তিনি বলেন, আমরা যারা নীট ওয়্যার গার্মেন্টস মালিক রয়েছি আমি বলবো আমরা প্রত্যেকেই শুধুমাত্র একজন লেবার কন্ট্রাক্টর। আমাদের দেশে কিছুই তৈরি হয় না। সব কিছুই বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। অনেকে বলেন স্থানীয় সূতা। আসলে কি স্থানীয় ভাবে কোন তূলা উৎপাদন হয়? যে পরিমান তূলা দেশে উৎপাদন হয় সেটা দেশের সাধারণ মানুষের লেপতোষক, বালিশ সহ অন্যান্য চাহিদা পূরণ করে। তূলা থেকে মেশিনের নিডেল পর্যন্ত আমাদের আমদানী করতে হয়। আর আমাদের মূলধন সম্পূর্নটা কিন্তু পারিবারিক ভাবে আসে নাই। ব্যাংক আমাদের মূলধনের জোগান দিয়েছে। সেই হিসেবে এই সব কিছু রাষ্ট্রের সম্পদ।

শিশু শ্রম বন্ধের ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ২০২১ ও ২০৪১ এর দুটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন। একটি হয়তো আমরা দেখতে পারবো। আরেকটি দেখবে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। কিন্তু আমার কাছে অনেক অভিযোগ আসে বন্দর এলাকা থেকে প্রায় ৩ হাজার শিশু শ্রমিক এসে হোসিয়ারীতে কাজ করে। এটা আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে যদি সত্যিকার অর্থে আমরা দেশকে ভালবেসে থাকি। কারন আমরা যদি ভবিষ্যত প্রজন্মকে তুলে আনতে না পারি তাহলে প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য ২০৪১ সফল হবে না। আমি শিল্প পুলিশ, জেলা পুলিশ, র‌্যাব সকলের উদ্দেশ্যে আমরা অনুরোধ থাকবে সকলে সম্মিলিত ভাবে এটা বন্ধ করতে হবে। একটা সময় আমাদের বিকেএমইএর সদস্য প্রতিষ্ঠান গুলোতে শিশু শ্রম ছিল। আমরা সেটা আইন করে বন্ধ করেছি। কোন কারখানায় শিশু শ্রমিক পাওয়া গেলে তাদের ১ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়েছে। এখন আর জরিমানা নয় ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সই বাতিল করা হবে।

শ্রমিকলীগ নেতা মতিন মাস্টার ও কাউসার আহম্মেদ পলাশকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আমাদের সময়ের রাজনীতি এবং বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতিতে অনেক তফাৎ রয়েছে। আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছি। আর এখন সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে। আমি শ্রমিকদের সম্মান করি তাদেরকে অর্থনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা বলে থাকি। কারন শ্রমিকেরা কাজ না করলে আজকে বাংলাদেশের জিডিপি এতো উপরে উঠতো না। বঙ্গবন্ধুর পায়ে অস্ত্র জমা দিয়েই আমরা অর্থনৈতিক মুক্তির কাজে নেমেছি। গত কয়েকদিন ধরে শহরে সৌন্দয্য বর্ধনের নামে বেশ কয়েকটি স্থানে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিনা নোটিশে হাজীগঞ্জে ভাংচুর করা হয়েছে। বিজিএমইএ ভবন সরকার ভেঙ্গে দিয়েছে বাংলাদেশের সব থেকে সৌন্দর্য্যবর্ধনকারী স্থান হয়েছি ওই জায়গা। তারপর সরকার তাদেরকে প্রায় তিন বছর সময় দিয়েছে। অথচ আমার নারায়ণগঞ্জে শত শত ব্যবসায়ীকে রাস্তায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিককে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। রহমত উল্লাহ ইন্সটিটিউট ও বিনোদন সুপার মার্কেটের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু সেগুলো ভেঙ্গে দেওয়া হলো। যারা এসি রুমে বসে ব্যবসা পরিচালনা করতেন তারা এখন ফুটপাতে বসে ব্যবসা করছেন। জিম খানা বস্তি উচ্ছেদ করে দিয়ে শত শত পরিবারকে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন মানুষদেরকে সময় দেওয়া হলো না। আর হাজীগঞ্জের ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে তারা যেন আইনগত সহযোগীতা নিতে না পারেন সেজন্য বৃহস্পতিবার অনেক গুলো সংস্থা মিলে এ উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। এতো গুলো সংস্থা অভিযান চালালেন অথচ জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার বলতে পারলেন না নির্দেশ কোথা থেকে আসলো। অথচ সিটি কর্পোরেশন তাদের সহযোগীতা করলো। শিল্প পুলিশ জানলো না শিল্প কারখানা ধ্বংস করা হলো। প্রায় তিন হাজার শ্রমিককে পথে বসিয়ে দেওয়া হলো ,কোথায় যাবে এসব শ্রমিকেরা। অথচ কেউ কোন কথা বলছে না। কোথায় এখন নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক নেতারা? অথচ আমরা এক মাসের বেতন দিলে বিলম্ব হলে উনারা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেন।

তিনি আরো বলেন, ২০০১ সালে ৪ দলীয় ঐক্যজোট ক্ষমতায় এসে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনার কায়দায় নারায়ণগঞ্জকে ধ্বংস করেছে। সেই সময় বিএনপি জামায়াত জোট সরকার বিশেষ কায়দায় আদমজী জুট মিল, বাওয়া জুট মিল, র‌্যালী বাদ্রাস, চিত্তরঞ্জন কটল মিল, ঢাকেশ্বরী টেক্সটাইল, লক্ষ্মী নারায়ণ কটল মিল ধ্বংস করে প্রায় ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট করে দেয়। সেই ৫ লাখ শ্রমিক বেকার হওয়ার ফলে তাদের পরিবার গুলোতে বেকারত্বের অভিশাপ নেমে আসে। সেই সকল শ্রমিক পরিবারের সন্তানের বাসস্থান ও শিক্ষা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। যার ফলে নারায়ণগঞ্জে একটি অরাজকতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রেকারত্ব অভিশাপ হয়ে দারিদ্রতার থাবা মেরেছে পরিবার গুলোতে। যার ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে বেছে নিয়েছে অপরাধের পথ, ঘটেছে অনেক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড জন্ম নিয়েছে অসংখ্য সন্ত্রাসী।

তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর মদনগঞ্জের শান্তিরচরে একটি শিল্পাঞ্চন অনুমোদন দিয়েছেন। প্রয়োজনে তাদেরকে সেখানে পূণর্বাসন করতে পারতো। ব্যবসায়ীদের নোটিশ দিয়ে তাদেরকে ৩ থেকে ৬ মাসের সময় দেওয়া যেত।

নীটওয়্যার সেক্টর সারা দেশের উন্নয়নের কার্যকরী ভূমিকা রাখছে বলে তিনি উল্লেখ করেন, সারাদেশের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ একমাত্র জেলা যেখান থেকে সব থেকে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়ে থাকে। এজন্য আজকে দেশের কোথাও মঙ্গা শব্দটি শোনা যায়। কারন আমাদের এখানে যারা কাজ করে তারা রংপুর, ফরিদপুর, দিনাজপুর, বগুড়া সহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এসে কাজ করে তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যার ফলে দেশের উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজনীয় সকল কাচাঁমাল বিদেশ থেকে আমদানী করতে হবে। আমাদের নিজস্ব শুধু শ্রমিক। এই শ্রমিকদেরকে আমাদের বাচিয়ে রাখতে হবে। শিল্প পুলিশ মালিকদের জন্য নয়। শিল্প পুলিশ অবশ্যই শ্রমিকদের জন্য শ্রমিকদের পক্ষে শ্রমিকদের স্বার্থে কাজ করবে। কারণ শ্রমিক বাচঁলে আমার দেশ বাচবে।

শিল্প পুলিশ নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার সৈকত শাহীনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন- বিকেএমইএ এর সহ সভাপতি (অর্থ) মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল, পরিচালক মনসুর আহম্মেদ, মোস্তফা জামাল পাশা, খন্দকার সাইফুল ইসলাম, নন্দ দুলাল সাহা, শাহাদাৎ হোসেন ভূইয়া সাজনু, এম এম ভূইয়া, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি মজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া সহ বিভিন্ন শ্রমিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা।