সান নারায়ণগঞ্জ
চলতি মাসের ৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ-৩(সোনারগাঁ-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নানকে মনোনিত ঘোষণা করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে এই প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেই তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছেন এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিত ৭ জন ব্যক্তি, যাদের মধ্যে অধিকাংশরাই বিএনপির বিগত আন্দোলন সংগ্রামে কোনো ভুমিকায় ছিলেন না।
নেতাকর্মীরা বলছেন, ৭ জনের মধ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বিএনপির দল ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রকারী সংস্কারপন্থী রেজাউল করিম, যিনি গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বিএনপির রাজনীতিতে নামেন। এর আগে তিনি প্রতি ৫ বছর পরপর নির্বাচনকালে গর্ত থেকে বের হয়ে রাজনীতির মাঠে আসেন। নির্বাচন থেকে তিনি আবারো লুকিয়ে থাকেন। গেল ৫ বছর আগে তিনি নিজেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ্য দাবি করে কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার পতনের পর আবারো রাজনীতির মাঠে এসে মনোনয়ন শিকারে নেমে পড়েন।
২০২২ সালে জেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকারকে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হলে জেলা বিএনপিতে নেতৃত্ব শূণ্যতার কারনে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় গিয়াসউদ্দীনকে জেলা বিএনপির দায়িত্ব দেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি। দায়িত্ব পাওয়ার পরেও নিজেকে আড়ালে আবডালে রেখে জেলা বিএনপির দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনিও প্রতিটি নির্বাচনে মাস কয়েক পূর্বে রাজনীতির মাঠে আসতেন আবার নির্বাচন থেকে নীরব হয়ে যেতেন।
অধ্যাপক মামুন মাহামুদ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হলেও তিনি জেলা বিএনপির সঠিক নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। কর্মী শূণ্যতায় ভোগা মামুন মাহামুদ জেলা বিএনপির রাজনীতিতে পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেননি। নারায়ণগঞ্জ-৩ কিংবা ৪ আসনে মনোনয়নকে টার্গেট করলেও জনপ্রিয়তার তলানীতে থাকায় মনোনয়নের দ্বারে কাছেও যেতে পারেননি মামুন মাহামদু। তবে ষড়যন্ত্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি ঠিক সামনে থেকে।
জাতীয় নির্বাচন করার মত শক্তি সামর্থ জনপ্রিয়তা কিংবা রাজনীতিতে তাদের উল্লেখ্যযোগ্য কোনো অবদানই নেই, তারা হলেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এসএম ওয়ালিউর রহমান আপেল, সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি খন্দকার আবু জাফর, উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আল মুজাহিদ মল্লিক, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সহ-সভাপতি ওয়াহিদ বিন ইমতিয়াজ বকুল। কিন্তু তারা একজোট হয়ে নিজেদের যোগ্য প্রার্থী দাবি করে মান্নানকে অযোগ্য দাবি করে দলের কাছে মনোনয়ন বাতিল চেয়ে আড়ালে আবডালে গোপনে বৈঠক করে আবেদন দরখাস্ত লিখেছেন এবং কেন্দ্রে জমা দিয়েছেন।
নেতাকর্মীদের আরো অভিযোগ রয়েছে, গত ১৭ বছর যারা আওয়ামীলীগের সাথে গোপন আতাঁত করে বিএনপির দুঃসময়ে মাঠে দেখা যায়নি, তারাই আজ ব্যক্তিস্বার্থে মনোনয়ন না পেয়ে মান্নানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ নভেম্বর মঙ্গলবার মনোনয়ন বঞ্চিত রেজাউল করিম, মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, ওয়ালিউর রহমান আপেল, মামুন মাহমুদ, ওয়াহিদ বিন ইমতিয়াজ বকুল, খন্দকার আবু জাফর ও আল-মুজাহিদ মল্লিক একযোগে তারেক রহমান বরাবর একটি অভিযোগপত্র পাঠান। অভিযোগপত্রটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে।
অনুসন্ধান বলছে, তারা যে অভিযোগ এনে মান্নানের মনোনয়ন বাতিলের দাবি তুলেছেন, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণীত ও প্রমাণহীন। বরং তাদের নিজেদের অতীত বিতর্ক, স্বেচ্ছাচারিতা ও ব্যক্তিস্বার্থই এখন আলোচনায় উঠে এসেছে। তৃণমূল নেতাদের মন্তব্য, যারা বিএনপির কঠিন সময়ে মাঠে ছিলেন না, দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াননি, আজ তারাই জনপ্রিয় একজন ত্যাগী নেতা মান্নানকে সামনে রেখে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ষড়যন্ত্রে নেমেছেন।
১/১১ সময় দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংস্কারপন্থীদের সাথে সম্পৃক্ত থাকা, আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা, কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকা এবং খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করা—এসব কারণে রেজাউল করিমকে নিয়ে জনমনে ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘদিন মাঠে কার্যত অনুপস্থিত থেকেও হঠাৎ মনোনয়ন চাওয়াকে তৃণমূল নেতারা হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছেন।
বিতর্কিত মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের বিরুদ্ধেও রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। “বিএনপিতে কোটি টাকায় মনোনয়ন বিক্রি হয়”—এমন বক্তব্য দিয়ে তিনি দলকে অপমান করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ৫ আগস্টের পর সিদ্ধিরগঞ্জের ‘অঘোষিত ক্ষমতা’ হিসেবে তার অনুসারীদের নানা অপকর্ম তৃণমূল নেতাদের ক্ষুব্ধ করেছে। নেতাকর্মীদের বক্তব্য—গিয়াসউদ্দিনই মূলত তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত অমান্য করার নায়ক, কারণ তিনি জানেন মাঠে মানুষের সমর্থন নেই।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক মামুন মাহমুদের বিরুদ্ধেও দলীয় কর্মীদের কঠোর ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। কিছুদিন আগেও তিনি প্রকাশ্যে মান্নানের প্রশংসা করে বলেছিলেন—“মান্নানই এই আসনের যোগ্য প্রার্থী।” এখন একই ব্যক্তির হঠাৎ মান্নানবিরোধী অবস্থানকে তৃণমূল নেতারা বিশ্বাসঘাতকতা বলছেন।
এ ছাড়া যুবউন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ওয়ালিউর রহমান আপেল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সহ-সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ বকুল, মীর জাফরখ্যাত সাবেক উপজেলা সভাপতি আবু জাফর এবং মান্নানের হাত ধরে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া হলেও জনসমর্থনহীন আল-মুজাহিদ মল্লিক এই চারজনও ষড়যন্ত্রের দলে যুক্ত হয়েছেন। ৫ আগস্টের আগে দলের প্রতি কোনো ভূমিকা না রাখা, দীর্ঘ ১৭ বছর নির্যাতিত নেতাকর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং নিজ নিজ এলাকায় ভোটার ও কর্মী না থাকা—এসব কারণে তারা এখন তীব্র সমালোচনার মুখে।
এই ঘটনাকে ঘিরে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি “রাজনৈতিক ঈর্ষা ও ব্যর্থতার কুপ্রভাব”। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি সাবেক আহবায়ক মনিরুল ইসলাম রবি বলেন,
“যে নেতারা দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তারা হঠাৎ করে নির্বাচন এলে সক্রিয় হন। জনপ্রিয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা তাদের পুরনো রাজনৈতিক দুর্বলতাকে সামনে এনেছে। এটি সুস্পষ্টভাবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা।”
নারায়ণগঞ্জ মহিলাদলের সাধারণ সম্পাদক আয়েশা আক্তার দিনা বলেন,“মান্নান একজন মাঠচেনা নেতা, তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। বরং এটি অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। মনোনয়ন–বঞ্চিত নেতারা নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে এই পথ বেছে নিয়েছেন।”
সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন বলেন,“মান্নান ভাই আমাদের দুঃসময়ে পাশে ছিলেন। যেদিন অন্য নেতারা গা ঢাকা দিয়েছিলেন, সেদিন তিনিই মাঠে নামতেন। আজ তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র আমাদের হৃদয়ে আঘাত করেছে।”
নারায়ণগঞ্জ মহানগর স্বেচ্ছাসেবকদলের সদস্য সচিব মমিনুর রহমান বাবু বলেন,“গিয়াসউদ্দিনসহ কয়েকজন নেতার রাজনীতি এখন শুধু ব্যক্তিস্বার্থকে ঘিরে। তারা মাঠে নেই, জনগণের মাঝে নেই, শুধু চেয়ার পাওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয়।”
সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপি যুগ্ম সম্পাদক আতাউর রহমান প্রধান বলেন,“নেতাদের পরিবার নিজেরাই ভোট দিতে চায় না—এমন নেতারা জনগণকে নেতৃত্ব দেবে? মান্নানকে দেখে ভয় পেয়েই তারা একজোট হয়েছে। কিন্তু জনগণ সব দেখছে।”
এদিকে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আজহারুল ইসলাম মান্নান বলেন, “আমি জনগণের সন্তান। তৃণমূল নেতাকর্মীরা আমার শক্তি। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণীত। সোনারগাঁ–সিদ্ধিরগঞ্জের মানুষ আমাকে ভালোবাসে, তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই আমার পথের দিশা। ইনশাআল্লাহ নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করে এই আসন আগামীর নেতার হাতে তুলে দেব।”
সোনারগাঁ–সিদ্ধিরগঞ্জের মানুষের প্রত্যাশা-দীর্ঘদিনের ত্যাগী, পরিচ্ছন্ন ও জনপ্রিয় নেতা আজহারুল ইসলাম মান্নানকে কেন্দ্র করেই বিএনপি আবার মাঠে শক্ত অবস্থানে ফিরবে। আর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে জনগণের এই অভিন্ন অবস্থানই প্রমাণ করে, তারা এখন রাজনৈতিকভাবে চরম চাপে এবং জনবিচ্ছিন্নতার শিকার।


