সেলিম ওসমানের আসনে ‘বিএনপি নেতা বিকিকিনি’

দিনকাল নারায়ণগঞ্জ ডটকম:

নারায়ণগঞ্জ-৫(শহর-বন্দর) আসনে আবারো উপ-নির্বাচনের মতই বিকিয়ে যাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের বিএনপি নেতারা। ইতিমধ্যে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী একেএম সেলিম ওসমানের নির্বাচনী সভায় গিয়ে সেলিম ওসমানকেই নির্বাচিত করার ঘোষণা দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি আতাউর রহমান মুকুল, সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত হাশেম শকু, দপ্তর সম্পাদক হান্নান সরকার ও বিএনপি নেতা সুলতান আহমেদ। এদের মধ্যে হান্নান সরকার নিজেই একটি অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়েছেন সেলিম ওসমানকে এমপি নির্বাচিত করতে যত টাকা লাগবে তা হান্নান সরকার দিবেন। ফলে আবারো সামনে চলে আসছে বিএনপি নেতাদের কেনা বেচার বিষয়টি। এ আসনে বিএনপির কোন প্রার্থী না দিয়ে নাগরিক ঐক্যের উপদেষ্টা এসএম আকরামকে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনিত করে ঐক্যফ্রন্ট।

তবে বেশকটি সূত্রে জানাগেছে, এবারের নির্বাচনে বিগ এমাউন্ডের বাজেট রয়েছে বিএনপির কিছু নেতার জন্য। তারা হলেন- মহানগর বিএনপির সেক্রেটারি এটিএম কামাল, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুকুল ইসলাম রাজীব ও মহানগর যুবদলের সভাপতি মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের জন্য। এসবের মধ্যেস্থতা করবেন গত উপ-নির্বাচনের মতই নারায়ণগঞ্জের কিং মেকার খ্যাত বিএনপির সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী। মোহাম্মদ আলীও ইতিমধ্যে সেলিম ওসমানের নির্বাচনী সভায় গিয়ে তাকে নির্বাচিত করার ঘোষণা দিয়ে আসছেন। মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমেই নারায়ণগঞ্জের বিএনপির যে সব নেতারা এতদিন সেলিম ওসমানের সঙ্গে ছিলেন না তাদেরকে মুল টার্গেট রয়েছে কেনার। তবে অনেকেই বলেছেন, ইতিমধ্যে দেনদরবারও চলছে। এদের কেউ কেউ আবার আশায় রয়েছেন এসএম আকরাম আর্থিক সুবিধা নিয়ে টেনে নেন কিনা।

এসব নেতাদের ছাড়াও সেলিম ওসমানের পক্ষে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সিটি কর্পোরেশনের বিএনপির ১৬ জন কাউন্সিলর। যাদের মধ্যে শওকত হাসেন শকু, হান্নান সরকার, সুলতান আহমেদ, এনায়েত হোসেন, গোলাম নবী মুরাদ ইতিমধ্যে সেলিম ওসমানের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। এছাড়াও রয়েছেন শহর বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি জমসের আলী ঝন্টু কমিশনার যিনি আগে থেকেই সেলিম ওসমানের হয়ে কাজ করছেন।

যা ঘটেছিল ২০১৪ সালের ২৬ জুন উপ-নির্বাচনে: ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। ওই নির্বাচনে এ আসনে মহাজোটের শরীক দল জাতীয়পার্টি থেকে মনোনয়ন পান প্রয়াত নাসিম ওসমান। ওই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়ন পান কেন্দ্রীয় শ্রমিকলীগের সভাপতি শুক্কুর মাহামুদ। আওয়ামীলীগ এ আসনটি জাতীয়পার্টিকে ছেড়ে দিলে শুক্কুর মাহামুদ তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন এবং বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় এমপি নির্বাচিত হন নাসিম ওসমান। ওই বছরের ৩১ এপ্রিল নাসিম ওসমান মৃত্যুবরণ করেন।

নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর এ আসনে ওই বছরের ২৬ জুন উপ-নির্বাচনে মহাজোটের লাঙ্গল প্রতীকে প্রার্থী হন সেলিম ওসমান। ওই নির্বাচনেও সেলিম ওসমানের পক্ষে মাঠে নামেন বিএনপির সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন এসএম আকরাম। নির্বাচনের সময় সেলিম ওসমানের মতবিনিময় সভায় নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে গিয়েছিলেন তৎকালীন শহর বিএনপির সভাপতি প্রয়াত জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইদ আহমেদ, সাবেক সহ-সভাপতি হাজী শাহিন, শহর মহিলা দলের সাবেক সেক্রেটারি দিলারা মাসুদ ময়নার মত নেতারাও।

বন্দরে সেলিম ওসমানের নির্বাচনী সভায় যান মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি আতাউর রহমান মুকুল ও হান্নান সরকার। সিটি কর্পোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ডের প্রতিটি কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন শওকত হাসেম শকু। কাজ করেছিলেন শহর বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি জমসের আলী ঝন্টুও। নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন এ ওয়ার্ডের আশপাশেই দেখা গিয়েছিল জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুকুল ইসলাম রাজীবকে। যদিও ওই সময় রাজীব দাবি করেছিলেন শুধুমাত্র তিনি নির্বাচনে ভোট গ্রহণের পরিবেশটি দেখতেই এক মুহুর্তের জন্য গিয়েছিলেন।

নির্বাচনের পূর্বে তৎকালীন শহর বিএনপির সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেন দেওয়ানের উপর যায় খড়গ। এমন সব নেতারা সেলিম ওসমানের পক্ষে কাজ করলেও কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলেও আনোয়ার হোসেন দেওয়ানকে অব্যাহতি দেয় বিএনপি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে আনোয়ার হোসেন দেওয়ান সেলিম ওসমানের লাঙ্গল প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করেছেন।

নির্বাচনে তৎকালীন শহর বিএনপির সেক্রেটারি এটিএম কামালের একটি বিবৃতি নিয়ে বিরোধীতা করেন শহর বিএনপির সহ-সভাপতি সুরুজ্জামান সহ অনেক নেতারা। কামালের বিবৃতিটি একজন প্রার্থীর পক্ষে চলে যাওয়ার কারনে রহস্যজনক ভুমিকায় এটিএম কামালকে বহিস্কার করার জন্য শহর বিএনপির নেতারা ডিআইটিতে বিএনপি কার্যালয়ে সভার আহ্বান করেন। ওই সভায় দলের কোরাম পূরন না হওয়ার কারনে এটিএম কামালকে বহিস্কার করা সম্ভব হয়নি।

ওই নির্বাচনের সময় আরো রহস্য দেখা যায়, যখন নির্বাচনের মাত্র ১৫ দিন আগেই তৎকালীন জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ও তার ভাই কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ দেশের বাহিরে চলে যান। দলের নেতাকর্মীদের কোন রকম নির্দেশনা না দিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করে অনেকটা সেলিম ওসমানকে সুযোগ করে দিয়ে তৈমূর আলম বিদেশে পাড়ি জমান। দেশের বাহিরে যান খোরশেদও।

নির্বাচনের আগের রাতে বিএনপি ও যুবদল ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের দেখা যায় নারায়ণগঞ্জের একটি অভিজাত ক্লাবে। মহানগর যুবদলের তৎকালীন যুগ্ম আহ্বায়ক সরকার আলম ওই ক্লাবে অনেক সময় পার করেও খালি হাতে ফিরে আসেন। যার ক্ষোভ তিনি পরের দিন স্থানীয় একটি পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘এটিএম কামাল ২ লাখ টাকা সেলিম ওসমানের কাছ থেকে নিয়েছেন। যা মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে দেয়া হয়।’ তবে নির্বাচনের দুইদিন আগে থেকেই ফতুল্লায় মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে সিরিয়াল ধরেছিলেন বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা। যাদের মধ্যে মহানগর বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল ইসলাম সজলও ছিলেন। ছিলেন শহর ও জেলা বিএনপির অনেক স্তরের নেতাকর্মীরা। অনেকে মোহাম্মদ আলীর সেই কার্যালয়ে খালি পকেটে ঢুকে ভরা পকেটে বের হন বলেও নেতাকর্মীরা মন্তব্য করেছিলেন। ওই নির্বাচনে সেলিম ওসমানের পক্ষে সরাসরি মাঠে ছিলেন মোহাম্মদ আলী।

এদিকে জানাগেছে, এবারের নির্বাচনেও তার ব্যতয় হবেনা। এবার বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন স্তরে ভাগ করে তাদের সেলিম ওসমানের পক্ষে নেয়ার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে অনেকেই সেলিম ওসমানের পক্ষে নেমে পড়েছেন। বেশকজন রয়েছেন পর্যবেক্ষনে। কেউ কেউ যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছেন মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। যে কারনে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনও এসএম আকরামের ধীনের শীষের পক্ষে নামছেন না। আরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে যখন মহানগর বিএনপির সভাপতি আবুল কালাম চিকিৎসার জন্য যাবেন সিঙ্গাপুরে। এই সুযোগে পকেট ভারির জন্য বিএনপি নেতাকর্মীরা মুখিয়ে রয়েছেন। ফলে এবারের নির্বাচনে এসএম আকরামের পক্ষে বিএনপি নেতাকর্মীদের তেমন একটা দেখা নাও যেতে পারে। এসব নেতাদের লাঙ্গলের পক্ষে ভাগিয়ে নিতে পারলে তাদের অনুসারীদের প্রতি নির্দেশনা থাকবে এসএম আকরামের বিপক্ষে ভোট দেয়ার জন্য। ফলে ভোট পাবেন সেলিম ওসমান।