কারাভোগ-পুলিশের পেটানি, বিএনপিতে জরিমানা!

মাজহারুল ইসলাম রোকন:

দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে রাজপথে পুলিশের এলোপাতারি প্যাদানি। তারপর টেনে হেছড়ে কাউকেবা চেংদোলা করে পুলিশ পিকআপে তুলে গ্রেপ্তার। তারপর মাসের পর মাস কারাবাস। প্রতিদিন আদালতের কাঠগড়ায় হাজিরা। ডজন ডজন মামলা। কারোবা সেই মামলা ৩০ ছাড়িয়ে। কিন্তু কমিটি গঠন ও নির্বাচনের সময় এরাই সবার আগে বাদ ও বাতিলের তালিকায়। এখন হয়তো উপলুব্ধির সময় যারা রাজপথে আন্দোলন করেন, যারা আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের পেটানি খান, যারা ডজন ডজন মামলায় আসামী হন, জেল খাটেন এবং মামলায় আসামী হয়ে বছর বছর বাড়ি-ঘর সংসার ছাড়া বালিশ ছাড়া বনে জঙ্গলে পথে ঘাটে রাস্তায় শুয়ে থাকেন তাদেরকে বিএনপি এখন রীতিমত জরিমানা আদায় করছে। এসব ত্যাগের বিনিময়ে তাদের কাছে এটাই জরিমানা যাদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যাদের মধ্যে অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান ও মশিউর রহমান রনি এখন কারাগারে বসেও হয়তো ভাবছেন এ কারাভোগটাই সামনে তাদের যেনো বিফলে গেল।

নেতাকর্মীরা বলছেন- নারায়ণগঞ্জে সবচেয়ে বেশি রাজপথে সক্রিয় ছিলেন এটিএম কামাল। যিনি মহানগর বিএনপির সেক্রেটারি। ২৪ ঘন্টা যিনি রাজনীতিতে মগ্ন। ৩৪টির মত মামলা তার ঘারে। রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে অমানসিক লাঠি পেটার শিকার হয়েছিলেন তিনি। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন গত দশ বছরে। তার জীবন থেকে গত দশ বছরে বেশকবার জেলখানায় থেকে কয়েক বছর কেটে গেছে সেখানেই। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে অযোগ্য প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হলেন এটিএম কামালই। নারায়ণগঞ্জ-৩(সোনারগাঁও) আসন থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। সোনারগাঁও বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু জাফর কিংবা চূড়ান্ত মনোনিত প্রার্থী আজহারুল ইসলাম মান্নানের ভুমিকা এটিএম কামালের দ্বারে কাছেও নাই। কিন্তু এটিএম কামালের টাকা নাই। তাই নমিনেশনের কাগজটিও তিনি দেখতে পারলেন না। সেখানে খন্দকার আবু জাফর আবার প্রতিবাদটা করেছেন কঠোর। তিনি প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন পেলেও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে জমাই দেননি। কারন তিনি আগেই বুঝে গেছেন পকেট গরম থাকা মান্নানের ঝুলিতেই যাবে দলের মনোনয়ন। তবে খন্দকার আবু জাফরের চেয়ে মান্নানের ভুমিকাও অনেক। এটিএম কামালকে জরিমানা করা হলো দিগুণ।

নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব তৈমূর আলম খন্দকার সেই ২০০৯ সালের ২৫ নভেম্বর। এর আগে তিনি সেক্রেটারি ছিলেন। ছিলেন আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্বে। দলের কঠিন সময়ে একাই দলকে চালিয়ে নিয়ে আসছিলেন। ২০১১ সালে সিটি নির্বাচনে তাকে প্রার্থী করা হলেও নির্বাচনের সাত ঘন্টা আগে তাকে বসিয়ে দেয়া হয়। ২০১১ সালের জুনে তিনি শহরের ২নং রেলগেট এলাকায় পুলিশের লাঠি পেটার শিকার হন। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি কোর্টের সামনে থেকে টেনে হেছড়ে তৈমূর আলমকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। জেলও খাটেন তিনি। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর হরতাল অবরোধ সভা সমাবেশে রাজপথে ছিলেন তিনি। গত বছরের ১৩ ফেব্রুযারি জেলা বিএনপির সভাপতির পদ থেকে তৈমূরকে সরিয়ে কাজী মনিরকে সভাপতি করা হয়। কিন্তু কাজী মনির সেক্রেটারি থাকলেও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে তৈমূরকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন তুলে দেয়া হয়েছে কাজী মনিরের হাতে। ফলে তৈমূরকে জরিমানা। এর আগেও জেল খেটেছিলেন ২৬ মাস।

এক সময় সংস্কারবাদীদের সঙ্গে গেলেও নারায়ণগঞ্জের ক্লিন ইমেজধারী রাজনীতিক অ্যাডভোকেট আবুল কালাম জেল খেটেছেন ২১ দিন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে বন্দরে আন্দোলন করে জাগানি দিয়েছিলেন আবুল কালাম। পরবর্তীতে বেশকটি মামলার আসামীও হন তিন বারের সাবেক এই এমপি। যিনি টেবিল রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত থাকলেও এবার তিনি মাঠে নেমেছিলেন। তার ছেলে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আবুল কাউসার আশাও জেল খেটেছেন বেশকবার। পুলিশের বেদম মারধরের শিকারও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এখানে জোটের তলালিতে আবুল কালামও পেলেন না দলের মনোনয়ন। এটাই তার জরিমানা কেন তিনি মামলা খেলেন, কেন তিনি জেল খাটলেন, কেন তার ছেলেকে রাজনীতিতে নামিয়ে তাকেও জেল খাটালেন।

জরিমানা গুণেছেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সভাপতি মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। যদিও তিনি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন প্রাপ্তীর তালিকায় ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামে যার ভুমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। জেলার মধ্যে মহানগর যুবদলের নেতাকর্মীরাই যেমন সক্রিয় ছিলেন রাজপথে তেমনি মামলার বোঝাও তাদের ঘারেই বেশি। যুবদলের কয়েক হাজার নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে ধাবিয়ে বেড়িয়েছিলেন খোরশেদ। কিন্তু মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক কমিটি থেকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনেও খোরশেদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। রাজপথে নির্যাতনের শিকার যুবদলের নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে নিষ্ক্রিয়দের নেতৃত্বে যুবদল। খোরশেদ জোড়াজুড়ি করলে হয়তো তার সভাপতি পদটিও হারাতেন। তিনিও জেল খেটেছেন বহুবার। রাজপথে একাধিকার পুলিশের লাঠি পেটার শিকার হয়েছেন। বছর বছর ঘর সংসার ছেড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন ফেরারী জীবনে। ফলে বড় ভাই তৈমূর আলম খন্দকারের মতই তাকেও করা হলো জরিমানা।

অধ্যাপক মামুন মাহামুদ। তিনি জেলা বিএনপির সেক্রেটারি। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে তিনি দলের মনোনয়ন চাইলেও প্রাথমিক তালিকায় তিনি মনোনয়ন পান। তবে এখানে জমিয়তের প্রার্থী দেয়া হয়। পাননি তিনিও। তার মনোনয়ন কিনেছিলেন দলের নেতাকর্মীরা যখন তিনি ছিলেন কারাগারে। জেল থেকে বের হয়ে সাক্ষাতকার দিলেও তিনি মনোনয়ন পাননি। ২০১২ সালে তিনি জেলা যুবদলের সভাপতি থাকাকালীন জেল থেকে বের হলে তার সভাপতি পদে কেড়ে নিয়ে কমিটিই বাতিল করে নতুন কমিটি গঠন করে যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা নিরব। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে সিদ্ধিরগঞ্জে আন্দোলনে নামতে গেলে পুলিশের বেদম মারধরের শিকার হন মামুন মাহামুদ। বেগম খালেদা খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তিনি সোনারগাঁও থেকে গ্রেপ্তার হন। কয়েক মাস কারাভোগের তিনি জামিনে মুক্তি পান। এর কদিন পরেই আবারো নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি। এর আগের মামলায় আদালতে মামুন মাহামুদকে কোমরে দড়ি বেধে আনা হয়।

অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। তিনি নারায়ণগঞ্জের একজন আলোচিত আইনজীবী। সাত খুনের ঘটনার সময় তিনি জোড়ালো আন্দোলন করে দেশব্যাপী আলোচিত হয়ে ওঠেন। যার বিনিময়ে তিনি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়নও পান। সেই নির্বাচনে পরাজিত হলেও তিনি রাজনীতিতে থেমে থাকেননি। নেমে যান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশা নিয়ে। কাজ করতে থাকেন মাঠে। ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি সাইনবোর্ড এলাকায় মিছিল করতে গিয়ে আরও দুই আইনজীবী নেতা সহ গ্রেপ্তার হন সাখাওয়াত। ১৮দিন কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। গত ৫ নভেম্বর তিনি নারায়ণগঞ্জ চাষাড়া থেকে গ্রেপ্তার হন। ১১ নভেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেলেও কারাগারের সামনে আরেকটি মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হন। এখনও তিনি রয়েছেন কারাগারে। তার পক্ষে নেতাকর্মীরা মনোনয়ন পত্র কিনেছিলেন। কিন্তু মনোনয়নের প্রাথমিক তালিকাতেও আসেনি তার নাম। ফলে তাকেও জেল খাটার দায়ে করা হয়েছে জরিমানা।