সুসময়ের অপেক্ষায় বিএনপিতে হঠাৎ বসন্তের কোকিল!

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

২০০৮ সাল থেকে বিএনপির যেসব নেতাকর্মীরা আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে গোপনে আতাত করে কিংবা প্রকাশ্যে সরকারি দল আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টির হয়ে রাজনীতি করেছেন এবং জাতীয় পার্টি ও আওয়ামীলীগ নেতাদের সঙ্গে মঞ্চে ওঠেছেন, কিংবা সরকারের এমপি মন্ত্রীদের মঞ্চে ওঠেছেন, কেউ কেউ প্রকাশ্যে নৌকা কিংবা লাঙ্গলের পক্ষে কাজ করেছেন, কেউ কেউ আপাদমস্তক আওয়ামীলীগার কিংবা জাতীয় পার্টির নেতা সেজেছিলেন তারাও এখন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী হতে মরিয়া। বিএনপির দলীয় কমিটিতে পদ পদবীতে বসতেও মরিয়া হয়ে ওঠেছেন তারা। বিএনপির কঠিন সময়ে যখন গুটিকয়েক নেতাকর্মীদের নিয়ে পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে মিছিল করেছেন তখন ওইসব নেতারা ঘরে বসে কিংবা আওয়ামীলীগ ও জাতীয়পার্টির হয়ে বিএনপি নেতাদের কটাক্ষ করেছেন, এখন তারাও সাচ্চা জাতীয়তাবাদী হতে মরিয়া।

দেশব্যাপী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনকালে নারায়ণগঞ্জের নিহত বিএনপি কর্মী শাওন প্রধান, ভোলায় নুরে আলম, আব্দুর রহিম, মুন্সিগঞ্জের শহীদুল ইসলাম শাওন ও যশোরের আব্দুল আলিমের স্মরণে বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত শোক র‌্যালী করেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপি। ৬ অক্টোবর মহানগর বিএনপি ও ১০ অক্টোবর জেলা বিএনপি এই কর্মসূচি পালন করেছেন কয়েক হাজার নেতাকর্মীদের নিয়ে। যেখানে ৬ অক্টোবর মহানগর বিএনপির মুলধারার পাশাপাশি পাল্টা কর্মসুচিতে শোডাউন করেছেন বিদ্রোহীরাও। গত কয়েক বছরেও নারায়গঞ্জ নগরীতে বিএনপির কোনো কর্মসূচিতে এত্ত নেতাকর্মীদের সমাগম ঘটতে দেখা যায়নি। দুটি দিনের কর্মসূচিতে বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মী সমর্থকদের মিছিলে মিছিলে বিএনপির নগরী হয়ে ওঠে।

সূত্রে, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে থাকাবস্থায়, ফতুল্লা থানার বিএনপির নেতৃত্বে থাকাবস্থায় সারা বছর আওয়ামীলীগ নেতাদের সঙ্গে মঞ্চে বসেছেন সদর ‍উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বিশ্বাস। এমনকি দেলপাড়ায় আওয়ামীলীগের এমপি শামীম ওসমানের আয়োজিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানানোর অনুষ্ঠানেও ছিলেন আজাদ বিশ্বাস। ওই একই মঞ্চে ছিলেন ফতুল্লা থানা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি মনিরুল আলম সেন্টু। যার মধ্যে সেন্টু আওয়ামীলীগে যোগদান করেছেন। আজাদ বিশ্বাস বিএনপির পদ হারানোর পর বিএনপির কোনো কর্মসূচিতেও নাই।

তবে এসব নেতারা বিএনপিতে এখনো না ফিরলেও এসব চরিত্রের অনেকেই বিএনপির রাজনীতিতে ফিরতে শুরু করেছেন। আওয়ামীলীগে যোগদানকারী টিএইচ তোফা এখন বিএনপির রাজনীতিতে, সোনারগাঁয়ের যুবদল নেতা রমজান আলী রাজুও এখন বিএনপির সকল মিছিলে সক্রিয়। এসবের কারন হিসেবে নেতাকর্মীরা বলছেন- বিএনপির সুসময়ের লক্ষন থেকে সুবিধাবাদীরা এখন বিএনপিতে ফেরার চেষ্টায় নেমেছেন। যারা গত ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করেছেন তাদেরকে বিতারিত করার চেষ্টায় তারা সাচ্চা জাতীয়বাদী সাজার চেষ্টায় নেমেছেন।

সারা বছর আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে এক মঞ্চে রাজনীতি করেছেন আতাউর রহমান মুকুল, হান্নান সরকার ও সুলতান আহমেদ। তারা এখন মহানগর বিএনপির কমিটির বিরোধিতা করছেন। অতীতে এলাকার উন্নয়নমুলক কর্মকান্ডের অনুষ্ঠান ছাড়াও জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক সভা সমাবেশেও উপস্থিত থেকেছেন প্রকাশ্যে তারা। এমনকি বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর বিরোধীতা করে জাতীয় নির্বাচনে প্রকাশ্যে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন তারা।

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরীক দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী একেএম সেলিম ওসমানের নির্বাচনী সমাবেশে প্রকাশ্যে উপস্থিত ছিলেন আতাউর রহমান মুকুল। হান্নান সরকারের বাড়িতেই সেলিম ওসমানকে নিয়ে লাঙ্গলের কর্মীসভা করেছেন হান্নান সরকার। সেলিম ওসমানকে বিজয়ী করতে যত টাকা লাগে হান্নান সরকার খরচ করারও ঘোষণা দেন সে সময়। সিরাজদ্দৌলা মাঠে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ধানের শীষের পক্ষে সমাবেশ করতে দেয়নি সুলতান। পরে অন্যত্র সমাবেশ করতে হয়।

২০১৫ সালে নগরীর খানপুরে সেলিম ওসমানকে সংবর্ধনা দেয়ার অনুষ্ঠানে আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত ব্যানার নিয়ে মিছিল করে যোগদান করেছিলেন হান্নান ও সুলতান। কিন্তু বিএনপির কমিটি গঠন আলোচনায় আসলেই তারা বিএনপিতে সরব হোন। এবারও তাই হয়েছে। মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনের পূর্বে বিএনপির মাঠে ফিরেন তারা। ১৩ সেপ্টেম্বর কমিটি হলে তারা বিদ্রোহ করে বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্থ করার মিশনে নামেন।

জানাগেছে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনের পর ১৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির বহিস্কৃত নেতা তৈমূর আলমের বাসায় গিয়ে মহানগর বিএনপির সদ্য ঘোষিত কমিটির ১৫জন নেতা পদত্যাগপত্র জমা দেন। এর মধ্যে ফারুক নামে একজন পদত্যাগ করেননি বলে দাবি করেন। যেখানে তৈমূর আলম খন্দকার বিএনপির কিছুই নন, তার হাতে দিয়েছেন পদত্যাগপত্র! ওইদিন নতুন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আতাউর রহমান মুকুল কেন্দ্রীয় বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদকে নারায়ণগঞ্জে অবাঞ্চিত ঘোষণা ও তার চামড়া তুলে নেয়ার ঘোষণা দেন।

বিএনপির বিতর্কিত এসব নেতাদের মধ্যে তৈমূর আলম খন্দকার গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হোন। নির্বাচনে তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করেই নারায়ণগঞ্জের আওয়ামীলীগের ওসমান পরিবারের পূর্বসুরী ও বর্তমান এমপিদের গুণকীর্তন শুরু করেন। তিনি আপাদমস্তক ওসমান পরিবারের লোক বনে যান তার নানা বক্তব্যে। নির্বাচনের মাঝে এমপি সেলিম ওসমানের ঘনিষ্ঠ জাতীয়পার্টির ৪জন ইউপি চেয়ারম্যানকে নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নামেন তিনি। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তিনি আবার নৌকার প্রার্থী মেয়র আইভীকে মিষ্টিমুখ করান। নির্বাচন শেষে তিনি বিএনপি থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কৃত হোন। কিন্তু তৈমূর আলমও এখন বিএনপিতে ফেরার চেষ্টায় নেমেছেন।

এদিকে ৬ অক্টোবর যখন মহানগর বিএনপির নবগঠিত কমিটির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু কেন্দ্রীয় কর্মসূচি শোক র‌্যালী পালন করেন। সেদিন সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে বিএনপির লোকজনদের হুমকি ধমকি ভয়ভীতি দেখিয়ে মুকুল গংদের পাল্টা র‌্যালীতে যোগদান করানোর চেষ্টা করা হয়। মুকুলের আয়োজিত র‌্যালীতে গেলে মামলা হবেনা কিন্তু সাখাওয়াত-টিপুর নেতৃত্বে র‌্যালীতে যোগদান করলে মামলার আসামি হতে হবে বলে নেতাকর্মীদের এমন ভয় দেখানো হয়। তারপরেও সাখাওয়াত ও টিপুর নেতৃত্বে বিশাল শোডাউন করে মহানগর বিএনপি।

গত ৬ অক্টোবর মহানগর বিএনপির শোকর‌্যালী অনুষ্ঠিতব্য ওই র‌্যালীর দুদিন পূর্বে মহানগর বিএনপির প্রস্তুতিমুলক সভায় বন্দর কদমরসূল পৌর বিএনপির সভাপতি ‍নূর মোহাম্মদ পনেছ তার বক্তব্যে তৈমূর আলম খন্দকার, আতাউর রহমান মুকুল, নূরুউদ্দীন ও মনোয়ার হোসেন শোখন সহ বিদ্রোহীদের অনেকের বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, সিটি নির্বাচনে তৈমূর আলম দালালে পরিনত হয়। নির্বাচনে আমার মত পনেছকে যদি কেন্দ্র থেকে পুলিশ ধরতে পারতো তাহলে ৪টা মামলা দিয়ে চালাল করতো। অথচ শোখনকে আটকাইয়া রাখছে মাত্র। কারন শোখন কেরম লোক আমরা সবাই চিনি তারে, তার টেকা পয়সা আছে, হের সব দলের লগে লিয়েজো আছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের গত নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি। তৈমুর আলম খন্দকার অংশগ্রহণ করায় বহিষ্কৃত হয়। কিন্তু মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে থেকেও সিটি কর্পোরেশনের ২৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেন আবুল কাউসার আশা। একইসঙ্গে তিনি মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি রয়েছেন। তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগের বিজয়ী মেয়র প্রার্থী ডাক্তার সেলিনা হায়াত আইভীর বাসায় ছুটে যান। সেখানে গিয়ে তিনি আইভীর পা ছুয়ে সালাম করে তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। এরপর মেয়র আইভীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেন। মেয়র আইভীর উপস্থিতি সহ সরকারের মন্ত্রীর অনুষ্ঠানেও মিছিল নিয়ে যোগদান করেন আশা। যা নিয়ে চরম সমালোচনা সৃষ্টি হয়। তিনি মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক পদে নির্বাচিত হলেও বহিস্কৃত তৈমুর আলম খন্দকারের হাতে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ১৩নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন তৈমূর আলম খন্দকারের ছোট ভাই মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। নির্বাচনে খোরশেদের জয় নিশ্চিত করতে ওসমান পরিবারের ইশারায় কাউন্সিলর প্রার্থী মহানগর আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি রবিউল হোসেন নির্বাচন থেকে সরে যান বলে অভিযোগ ওঠে। এমন অভিযোগে নির্বাচনের পূর্বেই রবিউল হোসেনকে আওয়ামীলীগ থেকে বহিস্কার করা হয়।

এর আগে ২০২০ সালে করোনাকালে মহানগর যুবদলের সভাপতির পদে থেকেও টিম খোরশেদ নাম দিয়ে নিজেকে হাইলাইটস করতে ব্যস্থ হয়ে পড়েন খোরশেদ। টানা দুই বছর টিম খোরশেদের ব্যানারে করোনাকালে কাজ করলেও বিএনপি কিংবা খালেদা জিয়ার নামে কোনো কর্মসূচি পালন করেননি। করোনাকালে জাতীয় পার্টির এমপি সেলিম ওসমান একটি অনুষ্ঠানে খোরশেদকে বীর বাহাদুর মন্তব্য করলে খোরশেদ নিজের দলের আদর্শ ভুলে গিয়ে সেলিম ওসমানের গুনকীর্তন শুরু করেন এবং ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে খোরশেদ ও তার কর্মীরা সেলিম ওসমানের বক্ত বনে যান। নিজেক বীর বাহাদুর ভাবতে শুরু করেন তিনি। করোনাকালে সেলিম ওসমানের সহযোগীতাও নেন তিনি। ডিসি অফিসে শামীম ওসমানের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানেও দেখা যায় তাকে। এসব কারনে পরবর্তীতে তাকে মহানগর যুবদল থেকে সরিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় যুবদল।