আড়াইহাজারে বিএনপির ‌‌’আজাদ ভাই কমিটি’: ব্যাকফুটে চাচা-ভাতিজা!

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলা, পৌরসভা ও গোপালদী পৌর বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়েছে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি। উপজেলা কমিটিতে দীর্ঘদিন যাবত রাজনীতি থেকেই নিস্ক্রিয় ইউসুফ আলী ভুঁইয়াকে আহ্বায়ক ও উপজেলা যুবদলের সাবেক চরম ব্যর্থ আহ্বায়ক জুয়েল হোসেনকে করা হয়েছে সদস্য সচিব! যেখানে নেতৃত্ব পায়নি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা নেতারা। মুলক বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের চাটারদের লোকজন হিসেবে তারা পদ ভাগিয়ে নেন। প্রকৃত নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে আজাদের অঙ্গুলী ইশারায় ওঠোবসো করা ব্যক্তিদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। তবে এই কমিটির ফলে আড়াইহাজারে বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত যারা করেছিলেন, সেই প্রয়াত নেতা বদরুজ্জামান খান খসরুর ছেলে মাহমুদুর রহমান সুমন ও তার চাচা সাবেক এমপি আতাউর রহমান খান আঙ্গুরের রাজনীতি খাদের কিনারায় ঠেকানো হয়েছে।

স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, মুলত বিএনপিকে আজাদের মুঠোবন্ধি করতেই আড়াইহাজার বিএনপিকে আজাদের লোকজনদের দিয়ে গঠিত হয়। এই কমিটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলও করেছিলেন পদবঞ্চিত নেতারা। একই সঙ্গে অবমুল্যায়নের অভিযোগে বিএনপির ৯জন নেতা পদত্যাগও করেন। কমিটিতে আঙ্গুর ও সুমন এবং তাদের নেতৃত্বে রাজনীতি করে আসা নেতাদের রাখা হয়নি। ওই সময় বিক্ষোভকারীরা বলেছিলেন, এখানে ভাইয়ের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই আজাদ ভাইমার্কা কমিটি দেয়া হয়েছে। বিএনপিকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র এটি।

কমিটি গঠনের পর ৯ ফেব্রুয়ারি আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপি, পৌরসভা ও গোপালদী পৌরসভা বিএনপির নবগঠিত কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির নবগঠিত কমিটির যুগ্ম আহবায়ক মো. হাবিবুর রহমান, সদস্য সালাউদ্দিন মোল্লা, মো. আনোয়ার হোসেন, আড়াইহাজার পৌরসভা বিএনপির ১নং সদস্য মোঃ আলী আজগর, সদস্য মাসুদা বেগম ও গোপালদী পৌরসভা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক অ্যাডভোকেট মোঃ মোশারফ হোসেন, অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেদ ও মো. বাবুল হোসেন।

জানাগেছে, আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির কমিটিতে ইউসুফ আলী মেম্বারকে আহ্বায়ক, সদস্য সচিব জুয়েল আহমেদ, যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল হোসেন ভূঁইয়া, মতিউর রহমান মতি, এড. খোরশেদ আলম মোল্লা, এড. সিদ্দিকুর রহমান, ফৌজিয়া ইয়াসমিন পপি, সফি উদ্দিন শফু, আতাউর মেম্বার, মাসুম শিকারী, আজহারুল ইসলাম লাভলু, সদস্য লুৎফুর রহমান আব্দু, খোরশেদ আলম, মনিরুজ্জামান দিপু, খন্দকার জানে আলম, মঞ্জুর মোল্লা, কাজী নাসির উদ্দিন, হারিছ ভূঁইয়া, সালাউদ্দিন মোল্লা, এড. গিয়াস উদ্দিন, আবুল কালাম, মোহামুদুল্লাহ লিটন, হাবিব আহমেদ, দেলোয়ার হোসেন, আব্দুল মালেক মেম্বার, হাজী মো. রতন, সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক, রফিকুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন জাকির হোসেনকে রাখা হয়।

আড়াইহাজার পৌরসভা বিএনপির আহ্বায়ক মো. রূপ চাঁন মিয়া, সদস্য সচিব সালাউদ্দিন আহমেদ ডালিম, গোপালদী পৌর বিএনপির আহ্বায়ক শামসুল হক মোল্লা, সদস্য সচিব মুশফিকুর রহমান মিলনসহ ৩১ বিশিষ্ট কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্য করা হয়।

পরে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে হাবিবুর রহমান হাবু বলেছিলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ অমান্য করে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ ও জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মামুন মাহমুদ আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে অসাংগঠনিকভাবে আড়াইহাজার উপজেলা, আড়াইহাজার পৌরসভা ও গোপালদী পৌরসভার বিতর্কিত কমিটি গঠন করেছে। তারা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ বিক্রি করেছেন। তাই কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছি।

সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, মনগড়া কমিটিতে দলের কোনো ত্যাগী নেতার স্থান হয়নি। মামুন মাহমুদ ও আজাদ দলের নাম ভাঙিয়ে সুবিধাবাদিদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তারা কমিটি বাণিজ্য করেছেন। এতে দলের ভাবমূর্তি চরমভাবে নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

অন্যদিকে নেতাকর্মীরা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জানান, আড়াইহাজার বিএনপির রাজনীতি বলতে এক সময় বুঝানো হতো প্রয়াত বিএনপি নেতা এমএ বদরুজ্জামান খান খসরু ও তার ভাই সাবেক এমপি আতাউর রহমান খান আঙ্গুর। দুই ভাইয়ের পারিবারিক রাজনীতি ছিল দীর্ঘদিন। এখানে দুই ভাইয়ের বিরোধই ছিল বিএনপির প্রধান বাধা। খসরুর মৃত্যুর পর নতুন করে আলোচনায় একজোড়া চাচা-ভাতিজার রাজনীতিতে বন্ধি হয় বিএনপি। আড়াইহাজার বিএনপি ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। একপক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন আঙ্গুর, আরেক পক্ষের নেতৃত্বে তারই ভাই খসরু। দীর্ঘদিন এমনটা চলার পর আড়াইহাজার বিএনপিতে উদয় হোন নজরুল ইসলাম আজাদ। তার সুবাদে তারই চাচা লুৎফর রহমান আব্দু হয়ে যান জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি। বর্তমান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফর রহমান আব্দুু। তার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড বলতে কেবল ভাতিজা নজরুল ইসলাম আজাদ।

এদিকে খসরুর মৃত্যুর পর নিজেকে আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পরিচয় দেন তারই ছেলে মাহমুদুর রহমান সুমন। খসরু ছিলেন আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সেক্রেটারি ছিলেন হাবিবুর রহমান ও সিনিয়র সহ-সভাপতি মীরজুল হাসান নয়ন মোল্লা। কার্যত নয়ন মোল্লাই ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সাংগঠনিক নিয়ম। কিন্তু সুমন নিজেকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বনে যান। এতে বিরোধ বেড়ে যায়। সুমনের কাছ থেকে নেতাকর্মীরা সরতে থাকেন। সেই সুযোগ লুফে নেন আজাদ।

এদিকে আড়াইহাজার পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির দলীয় প্রার্থী হিসেবে যার ভরাডুবি হয়েছিলেন সেই কেন্দ্রীয় মহিলা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক পারভীন আক্তার। ২০২১ সালের ১৭ মার্চ আড়াইহাজার উপজেলার বিআরডিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক অর্থ বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন অনুকে আহ্বায়ক ও মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ চেয়ারম্যানকে সদস্য সচিব করে একটি খসড়া কমিটি জেলা বিএনপির নেতাদের হাতে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের দুজনের কাউকেই কমিটিতে রাখা হয়নি।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে আতাউর রহমান আঙ্গুর, নজরুল ইসলাম আজাদ ও মাহমুদুর রহমান সুমন মনোনয়ন পায়। কিন্তু চূড়ান্তভাবে নজরুল ইসলাম আজাদকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এর বছর দেড়েক আগে মৃত্যুবরণ করেন বদরুজ্জামান খান খসরু। তার মৃত্যুর পর হটাত করে বিএনপির রাজনীতিতে আসেন মাহমুদুর রহমান সুমনের। যাকে এর আগে রাজপথের আন্দোলনে তো দুরের কথা বিএনপির মানববন্ধনেও দেখা মিলেনি। জোর করে হয়ে যান আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। তার পিতা খসরু ছিলেন আড়াইহাজার বিএনপির সভাপতি। একই সঙ্গে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক।

২০০৯ সালের ২৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি হোন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ও সেক্রেটারি কাজী মনিরুজ্জামান মনির। কমিটি গঠনের কয়েক মাসের মাথায় আড়াইহাজারে বদরুজ্জামান খান খসরুকে সভাপতি ও হাবিবুর রহমান হাবুকে সেক্রেটারি করে একটি কমিটি দেন তৈমূর ও কাজী মনির। যে কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে মীরজুল হাসান নয়ন মোল্লা ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম মোল্লাকে রাখা হয়।

২০১৩ সালের দিকে আড়াইহাজারে ধীরে ধীরে আলোচনায় আসেন নজরুল ইসলাম আজাদ। ওই সময় থেকে হাবিবুর রহমান হাবু খসরুর নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে যেতে থাকেন। এক পর্যায়ে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে হাবুকে শোকজ করা হয়। শোকজের জবাব না দেয়ায় হাবুকে অব্যাহতি দিয়ে আবুল কাশেম ফকিরকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পদে বসান তৈমূর আলম খন্দকার। পরবর্তীতে খসরুর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়ান হলে তৈমূর আলম মৌখিকভাবে হাবুকেই সেক্রেটারি পদে থাকার বৈধতা দেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে। তারপর থেকে দুজনই সেক্রেটারি পরিচয় দেয়। কিছুদিন আজাদের বলয়ে ছিলেন হাবু। গত নির্বাচনের আগে আজাদের বিরুদ্ধে জিডিও করেছিলেন হাবু। পরবর্তীতে আবারো আজাদ বলয়ে যান এবং কমিটি না পাওয়ার শঙ্কা তৈরি হলে আবার সুমন বলয়ে চলে যান হাবু।