সোনারগাঁয়ে জয়ী চাচা ভাতিজা, হেরে গেল এমপি খোকা ও কালাম

সান নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:

নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের লড়াইয়ে পরাজয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক অস্তিত্বের লড়াইয়েও হেরে গেল নারায়ণগঞ্জ-৩(সোনারগাঁও) আসনের মহাজোটের এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা ও তার সমর্থিত আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাহফুজুর রহমান কালাম। রাজনৈতিক এই লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন সোনারগাঁয়ের আওয়ামীলীগের পরিবার খ্যাত হাসনাত পরিবারের দুই সদস্য আওয়ামীলীগের সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত ও তার চাচা মোশারফ হোসেন। নির্বাচনে প্রায় ২৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন মোশারফ হোসেন। এই নির্বাচনে মুল লড়াইটা ছিল স্থানীয় এমপির সঙ্গে হাসনাত পরিবারের।

জানাগেছে, ৩১ মার্চ রবিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। ভোট গণনা শেষে রবিবার রাতে উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে ফলাফল ঘোষণা করেন রিটার্র্নিং অফিসার। নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে মোশারফ হোসেন পেয়েছেন ৭৩ হাজার ৩৮ ভোট এবং তার একমাত্র প্রতিদ্বন্ধি আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাহফুজুর রহমান কালাম পেয়েছেন ৪৫ হাজার ৬’শ ৫৯ ভোট। বেসরকারিভাবে মোশারফ হোসেনকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণকে ঘিরে অস্তিত্বের লড়াইয়ে নামেন নারায়ণগঞ্জ-৩(সোনারগাঁও) আসনের মহাজোটের এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা ও সোনারগাঁয়ের আওয়ামীলীগের পরিবার হিসেবে পরিচিত পাওয়া হাসনাত পরিবার। নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছেন হাসনাত পরিবারের সদস্য মোশারফ হোসেন। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্ধি আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ঘোড়া প্রতীকে লড়েছেন উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি মাহফুজুর রহমান কালাম। এখানে মুলত মুল লড়াইটাই হয়েছে বর্তমান এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা ও আওয়ামীলীগের সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাতের মধ্যে। খোকা ছিলেন কালামের পক্ষে আর মোশারফের পক্ষে ছিলেন কায়সার।

স্থানীয়রা আরও বলছেন, এখানে নির্বাচনে মাহফুজুর রহমান কালাম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে হুমকির মুখে পড়তো হাসনাত পরিবার এবং হাসনাত পরিবারের দুই সদস্য কায়সার হাসনাত ও মোশারফ হোসেন। আবার মোশারফ হোসেন নির্বাচিত হওয়ায় এখন সোনারগাঁয়ে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে হুমকির মুখে পড়লেন কালাম। সেই সঙ্গে চরম বিপাকে থাকবেন মহাজোটের এমপি লিয়াকত হোসেন খোকাও। সোনারগাঁয়ে তার প্রভাব বিস্তার নড়বড়ে হয়ে যাবে।

এর কারন হিসেবে সোনারগাঁয়ের মানুষ বলছেন, এখন উপজেলা পরিষদের যাবতীয় কাজ ও নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে হাসনাত পরিবারের হাতে। স্থানীয় এমপি লিয়াকত হোসেন খোকার এখন জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন ছাড়া আর কিছুই থাকবেনা সোনারগাঁয়ে। এমপি খোকা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে এখন এমপি খোকা ও মোশারফ হোসেনের লোকজনদের সঙ্গে হানাহানি মারামারি কিংবা টেহুারবাজি নিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে বলেও সেটা অনুমেয়। এক্ষেত্রে সোনারগাঁয়ে এমপি খোকার প্রভাব একেবারেই শূণ্যের কোঠায় চলে যেতে পারে। সেই সঙ্গে এমন পরাজয়ের ফলে সোনারগাঁয়ে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে বর্তমানের প্রভাব হারাবেন কালাম। এখন হয়তো আবারো তাকে হাসনাত পরিবারের ছায়াতলে আসতে হতে পারে। ভবিষৎে জাতীয় নির্বাচন কিংবা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দাড়ানোর স্বপ্ন দেখাটাই তখন কালামের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠতে পারে। সঙ্গে সোনারগাঁয়ে আবারো প্রভাব ফিরে পেতে যাচ্ছে হাসনাত পরিবার। হয়তো সোনারগাঁও থেকে নারায়ণগঞ্জে ফিরে আসতে হবে এমপি খোকাকে।

আবার অনেকেই বলছেন, যদি কালাম ঘোড়া প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যেতো তাহলে সোনারগাঁয়ে আওয়ামীলীগের ঐতিহ্যবাহী হাসনাত পরিবারের রাজনীতি শেষের দিকে চলে যেতো। তখন সোনারগাঁয়ে আওয়ামীলীগের রাজনীতির একক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রন চলে যেতো কালামের হাতে। কালামের হাত ধরে সোনারগাঁয়ে টিকে থাকতে পারতেন এমপি খোকাও। সেই লড়াইয়ের কারনেই এমপি খোকা ওঠে পড়ে লেগেছিলেন কালামের পক্ষে বিজয়ের মালা ছিনিয়ে আনতে। কালামের পক্ষেই অবস্থান নিয়ে প্রতিশোধের সুুযোগ নিতে চেয়েছিলেন গোয়ালদির সেই সাবেক এমপি আনম বাহাউল হকও। কারন ২০০১ সালে হাসনাত পরিবারের বিরোধীতার কারনেই পরাজিত হয়েছিলেন বাহাউল। যে কারনে বাহাউলের ভাই সোনারগাঁয়ের পৌর মেয়র সাদেকুর রহমান, শিল্পপতি ফেরদৌস ভূঁইয়া মামুন ও জেলা পরিষদের সদস্য ফারুক ভূঁইয়া কাজ করেছিলেন কালামের পক্ষে। তবে অস্তিতের লড়াইয়ে হাল ছাড়েনি হাসনাত পরিবার। ফলের জয়ের মালা গলায় নিয়ে এখন টিকে রইলো হাসনাত পরিবার।

এদিকে ঘোড়া প্রতীকে লড়েছিলেন আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাহফুজুর রহমান কালাম। তিনি ঘোড়া প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে ছিলেন। তার পক্ষে ছিলেন স্থানীয় এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা। নির্বাচনের আগে ঘোড়া প্রতীকের পক্ষে কাজ করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী এলাকা ছাড়তে খোকাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোশারফ হোসেনের পক্ষে মাঠে কাজ করেছিলেন সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত, জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর চৌধুরী বিরু, কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক এএইচএম মাসুদ দুলাল, উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট সামসুল ইসলাম ভূঁইয়া।

যদিও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান আহমেদ মোল্লা বাদশা কাজ করেছিলেন বিদ্রোহী প্রার্থী কালামের পক্ষে। কালামের পক্ষে কাজ করেছিলেন উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত চেয়ারম্যান জহিরুল হক, ইউসুফ দেওয়ান, আব্দুর রউফ মোল্লা, আব্দুর রব, হা-মীম শিকদার শিপলু, মোশারফ ওমর, ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান মাসুম, সোনারগাঁও পৌর মেয়র সাদেকুর রহমান ভূঁইয়া এবং পৌরসভায় নির্বাচিত কাউন্সিলর ও ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ডে নির্বাচিত অন্তত ৯০ জন মেম্বারগণ। এসব চেয়ারম্যানদের অনেকেই নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তারা কাজ করেছিলেন নৌকার বিরুদ্ধে গিয়ে ঘোড়া প্রতীকের পক্ষে।

এখানে উল্লেখ্যযে, গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৩(সোনারগাঁও) আসনে মহাজোটের শরীক দল জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে মনোনয়ন পান বর্তমান এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা। ওই নির্বাচনে আওয়ামীলীগের সঙ্গে বিদ্রোহী করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত ও মোশারফ হোসেন। মনোনয়ন বাছাইয়ে মোশারফ হোসেনের মনোনয়ন বাতিল হয়ে গেলে সিংহ প্রতীকে নির্বাচনে লড়াইয়ে নামেন কায়সার হাসনাত। কিন্তু নির্বাচনের ৭২ ঘন্টা পূর্বে কায়সার হাসনাতের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। তারপর নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান তিনি। ওই নির্বাচনে খোকার পক্ষে কাজ করেছিলেন কালাম এবং মোশারফ হোসেন কাজ করেছিলেন কায়সার হাসনাতের পক্ষে।