সান নারায়ণগঞ্জ
গণমাধ্যম বা সোস্যাল মিডিয়া ট্রায়ালে কিংবা সারাদেশের পাবলিক পারসেপশনে গিল্টি ড. তৈমূর আলম খন্দকার। কারো কারো দাবি- তিনি বিএনপি ছেড়ে তৃণমুল বিএনপি গঠন করেছেন, কারো কারো দাবি তিনি বিএনপি ছেড়ে তৃণমুল বিএনপিতে যোগদান করেছেন। দলের সঙ্গে তিনি বেইমানী করেছেন, বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, মীরজাফরী করেছেন। প্রথম সঠিক তথ্য হলো তিনি তৃণমুল বিএনপি গঠন করেননি, তিনি তৃণমুল বিএনপিতে যোগদান করে মহাসচিবের পদে দায়িত্ব নিয়েছেন নির্বাচনকালীন সময়ে। দলটি বিএনপির সাবেক নেতা নাজমুল হুদার গঠিত, যার বর্তমানে নেতৃত্বে নাজমুল হুদার কন্যা অন্তরা হুদা। এই দলে যোগদানের পূর্বে তৈমূর বিএনপিতে বহাল ছিলেন না। তৃণমুল বিএনপিতে যোগদানের দুই বছর পূর্বে তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করে দেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি।
তৈমূরকে নিয়ে নানা প্রশ্ন:
কেন তিনি বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হলেন? বহিষ্কারের পরের দুই বছর তিনি বিএনপির জন্য কি কিছু করেছিলেন কিংবা করেননি? তার প্রতি বিএনপির আচরণ কেমন ছিল? বহিষ্কারের পরের দুই বছর বিএনপির রাজনীতিতে তৈমূরের ভুমিকা কেমন ছিলো? তিনি কি তৃণমুল বিএনপিতে স্বদিচ্ছায় নাকি যোগদান করতে বাধ্য হয়েছিলেন? বিএনপিই কি তাকে তৃণমুল বিএনপিতে ঠেলে দিতে বাধ্য করেছিলো কিনা? ২০০৯ সালের পর থেকে বিএনপির রাজনীতিতে তিনি কতদিন দায়িত্ব পালন করেছেন, কি ছিল তার ভুমিকা?
উপরের প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে। নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে যারা তৈমূর আলম খন্দকারের নেতৃত্ব মানতে চাননি কিংবা চায়না তারাই তৈমূর আলম খন্দকারকে নিয়ে যার যা খুশি তথ্য ছড়িয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য কেউ তুলে ধরেননি, বা তথ্যের কারনে তুলে ধরছেন না। সারাদেশের মানুষের মাঝে তথ্য হলো তৈমূর বিএনপি ছেড়ে তৃণমুল বিএনপিতে যোগদান করেছেন- কিন্তু আদৌ সেটা সঠিক নয়।
বিএনপিতে তৈমূরের ভুমিকা ও অবদান:
১৯৯৮ সালে বিএনপিতে যোগদানের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক পদে দায়িত্ব পান তৈমূর আলম খন্দকার। ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সম্মেলনে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হোন তৈমূর। সভাপতি হোন অধ্যাপক রেজাউল করিম। এরপর ১/১১ এর সময় বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গ্রেপ্তার হলে সেই সময় বিএনপির কোনো আইনজীবী তারেক রহমানের পক্ষে ওকালতনামা দিয়ে আইনি লড়াই চালাতে সাহস করেননি। কিন্তু তৈমূর আলম খন্দকার তারেক রহমানের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়ে যান। এরপর তৈমূর আলম খন্দকারকেই সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে।
বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে তৈমূরকে নির্যাতন করে চাপ সৃষ্টি করে বলা হয়েছিল। কিন্তু অমানসিক নির্যাতনেও তার মুখ থেকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কথা বলাতে পারেনি সেনা বাহিনী। যার ফলশ্রুতিতে তিনি দীর্ঘ ২৬ মাস কারাভোগ করেন। ১/১১ এর সময় যখন সংস্কারের নামে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে মাইনাসের চক্রান্ত চলছিল তখন তৈমূর কারাগারে থেকে জিয়া পরিবারের পাশে থেকেছেন। সংস্কারপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলাননি।
কারামুক্ত হয়ে ২০০৯ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হোন তৈমূর। ওই কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কাজী মনির। প্রথমে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং পরবর্তীতে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হোন তিনি। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তৈমূর। ওই সময় ব্যাপক জনপ্রিয় দল বিএনপি ও ধানের শীষের প্রার্থী তৈমূরের জয়ের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ভোটের মাত্র ৭ ঘন্টা পূর্বে বেগম খালেদা জিয়া তাকে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলে তৈমূর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত টানা ৮ বছর জেলা বিএনপির সভাপতির পদের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর কাজী মনিরকে সভাপতি পদে দায়িত্ব দিলেও ব্যর্থতার কারনে ২০২০ সালে আবারো তৈমুরকে জেলা বিএনপির দায়িত্ব দেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি। এরপর ২০২২ সালে তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেই হিসেবে ১/১১ এ থেকে শুরু করে আওয়ামীলীগ সরকারের মোট ১৭টি বছরের মধ্যে ১৩টি বছরই জেলা বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন তৈমূর। এরও আগে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও ২০০৩ সালে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হয়ে ১৯৯৮ সাল থেকেই ২০২২ সাল পর্যন্ত বলা যায় বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন তৈমূর। বর্তমানে যারা বলছেন ১৭টি বছর নারায়ণগঞ্জের রাজপথে আন্দোলন করেছেন? তাহলে তৈমূর এত্তগুলো কি করেছেন? রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে হামলা মামলা জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন। রাজপথে পুলিশের লাঠি পেটার শিকার হয়েছেন। হরতাল অবরোধে কখনো দলের ব্যানার ছেড়ে যাননি।
কেন তিনি বৃহিষ্কৃত হলেন:
২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন প্রসঙ্গে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেন ’বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না, তবে কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাহলে তাকে বাধাও দিবে না।’ এমন ঘোষণার পর নির্বাচনে নামেন তৈমূর। তার নির্বাচনী প্রধান এজেন্ট হোন তৎকালীন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল। নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম কেনা, জমা দান, প্রতীক নেয়ার পরেও তৈমূরকে নির্বাচন থেকে সরে যেতে কেন্দ্রীয় বিএনপির কেউ নিষেধ করেনি। কিন্তু তৈমূরের চারপাশে যারা নির্বাচনে কাজ করতেন তাদেরকে গোপনে গোপনে সরে যেতে বলা হলো! তবুও তৈমূরকে নিষেধ করা হলো না। চক্রান্তে পড়ে যায় তৈমূর। সর্বপরি এটিএম কামালকে নিষেধ করা হলেও তিনি তৈমূরের নির্বাচনের পক্ষে অটুটু থাকেন। ওদিকে আওয়ামীলীগের নৌকার প্রার্থী মেয়র আইভীর লোক আগেই প্রচারণা শুরু করে দিলো তৈমূর বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হবেন। ঠিক তাই হলো- এটিএম কামাল ও তৈমূরকে প্রথমে অব্যাহতি পরে বহিষ্কার ঘোষণা করা হলো। ২০১১ সালের সিটি নির্বাচনেও মেয়র আইভীর লোকজন আগেই প্রচারণা চালালো যে, তৈমুরকে সরিয়ে দেয়া হবে, কিন্তু তাই হলো- ভোটের ৭ ঘন্টা আগে তৈমূরকে সরিয়ে দেয়া হলো!
বহিষ্কৃত হওয়ার পর তৈমূরের ভুমিকা:
বহিষ্কৃত হওয়ার পরেও টানা দুইবছর বিএনপির সকল আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ভুমিকা রাখেন তৈমুর। ঢাকায় সকল কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের নিয়ে শোডাউন করে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় বিএনপি তার নামটিও অনুষ্ঠানে ঘোষণা করতো না। ঢাকায় তিনি নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে মাটিতেই বসে থাকতেন। নারায়ণগঞ্জের সকল হরতাল অবরোধও পালন করতেন বহিষ্কৃত তৈমূর। নেতাকর্মীরা তার বহিষ্কার প্রত্যাহারের জন্য একাধিকবার সভা সমাবেশে দাবি তুলেছিলেন। কেন্দ্রীয় বিএনপির কাছে তৈমূর আলমের বহিষ্কার প্রত্যাহারের জন্য একাধিক দরখাস্ত জমা দিয়েছিল নেতাকর্মীরা। বহিষ্কার প্রত্যাহারের জন্য তৈমূর আলমের চেষ্টারও কোনো কমতি ছিলো না। ওই সময় সর্বশেষ চেষ্টা তৈমূর তার বহিষ্কার প্রত্যাহার করাতে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করলেও সেখানেও তারেক রহমান তৈমূরকে সাক্ষাত দেননি। পরিশেষ বিএনপির চরম অবহেলা ও এই অবিচারেই তৈমূরকে তৃণমুল বিএনপি নামক দলে যোগদানে বাধ্য করলো। বিএনপি যখন আচরণে দেখালো তৈমূরকে বিএনপিতে আর প্রয়োজন নেই, তখনি তৈমূর বহিষ্কৃত অবস্থায় ২০২৩ সালে অনেকটা বাধ্য হয়েই তৃণমুল বিএনপিতে যোগদান করে ২০২৪ সালের নির্বাচনে অনেকটা জেদ করেই অংশগ্রহণ করেছেন।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও তিনি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি করেছেন। বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণহারে গ্রেপ্তার ও মামলার বিরোধীতা করে সরকারের সমালোচনা করেছেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেন তৈমূর আলম। বাসায় ছাদে গুলিতে নিহতের ঘটনায় সরকার পতনের আগেই সরকারের বিরুদ্ধে রিট মামলা দায়ের করেন তৈমূর।
২০২৪ সালের নির্বাচনের পরপরই তিনি তৃণমুল বিএনপি নামক দল থেকে সরে দাঁড়ান। সম্প্রতি গণমাধ্যমেও জানিয়েছেন এই দলের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তার পূর্বের দল বিএনপিতে ইতিবাচক সাড়া দিলে বিএনপির রাজনীতিতে ফিরবেন সেই আভাসও দিয়েছেন তিনি। তবে তিনি নিজ থেকে বিএনপিতে দরখাস্ত দিয়ে কিংবা নিজ থেকে প্রস্তাব দিয়ে বিএনপিতে ফিরতে নারাজ। গত শুক্রবার তিনি রূপগঞ্জে বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিল করেছেন। সেখানে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।


